★প্রশ্ন-(১) খেলাধুলা সম্পর্কে শরীয়তের ফায়ছালা কি? অনেকে বলে, ‘কিছু কিছু খেলা জায়িয।’ তা কোন কোন খেলা?
উত্তর-(১) এর জবাবে বলতে হয় যে, হাদীছ শরীফের বিখ্যাত কিতাব, “মুস্তাদরিকে হাকিম”-এর মধ্যে হযরত আবু হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত আছে যে, রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “সব প্রকার খেলা নিষিদ্ধ, তিনটি বিষয় ব্যতীত- (১) তীর ধনুক চালনা করা, (২) অশ্বকে প্রশিক্ষণ দান করা, (৩) নিজ স্ত্রীর সাথে শরীয়তসম্মত হাসি-খুশী করা।” আবু দাউদ শরীফ, তিরমিযী শরীফ, নাসাঈ শরীফ, ইবনে মাজাহ্ শরীফ ইত্যাদি হাদীছ শরীফের কিতাবেও হযরত ওকবা ইবনে আমির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে অনুরূপ হাদীছ শরীফ বর্ণিত রয়েছে। তবে শব্দের কিছু তারতম্য রয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে রেওয়ায়েত আছে, নবী করিম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “মু’মিনের শ্রেষ্ঠ খেলা অর্থাৎ প্রশিক্ষণ হচ্ছে সাঁতার কাটা, আর নারীর শ্রেষ্ঠ খেলা অর্থাৎ কাজ হচ্ছে সূতা কাটা।” “সহীহ্ মুসলিম” ও “মুসনদে আহমদ শরীফে” হযরত সালমান ইবনে আকওয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত আছে, “নবী করিম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দৌড় অনুশীলনে এজাযত দিয়েছেন।” (তবে অবশ্যই খেলা হিসেবে নয় বরং জিহাদের প্রশিক্ষণ হিসেবে।) আর “আবূ দাউদ শরীফে” বর্ণিত আছে, “নবী করিম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোকনা পাহ্লোয়ানকে কুস্তিতে ধরাশায়ী করেছিলেন।” (তবে তা অবশ্যই খেলা হিসেবে নয় বরং রিসালতের প্রমাণ ও মু’জিযা হিসেবে তিনি রোকনা পাহলোয়ানের সাথে কুস্তি করেছেন এবং তাকে পরাস্ত করেছেন।) প্রকৃতপক্ষে হাদীছ শরীফে তথা শরীয়তে যেসব বিষয়ের অনুমোদন রয়েছে, তা ব্যতীত যত প্রকার খেলা রয়েছে তার প্রত্যেকটির মধ্যেই, না-কোন দ্বীনী ফায়দা রয়েছে এবং না-কোন দুনিয়াবী ফায়দা রয়েছে। বরং প্রতিটি খেলা তিনটি অবস্থার কোন এক অবস্থা থেকে খালি নয়।
(ক) হয় তা কুফরী হবে, (খ) অথবা হারাম হবে, (গ) আর না হয় তা মাকরূহ্ হবে।
(ক) যে খেলা বিধর্মীদের সাথে তাশাব্বুহ্ বা সাদৃশ্য রাখে অথবা দ্বীন ইসলাম থেকে সরিয়ে দেয় বা কুফরীতে নিমজ্জিত করে তা সম্পূর্ণ কুফরী। হাদীছ শরীফে বর্ণিত রয়েছে, عن عمرو بن شعب عن ابيه عن جده ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال ليس منا من تشبه بغيرنا.
অর্থ: “হযরত আমর বিন শুয়াইব তাঁর পিতা থেকে এবং তিনি তাঁর দাদা থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী করিম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ঐ ব্যক্তি আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়, যে বিজাতীয়দের সাথে সাদৃশ্য রাখে।” (মিশকাত)
(খ) যে খেলা ইসলামী আক্বীদা থেকে সরিয়ে নেয়না কিন্তু হারাম ও গুণাহ্ কাজে লিপ্ত করে দেয়, তা কুফরী নয়, তবে কবীরা গুণাহ কারণ। অর্থাৎ হারাম।
কুরআন পাকে আছে: تعاونوا على البر والتقوى ولا تعاونوا على الاثم والعدوان
অর্থ: “তোমরা পরস্পর পরস্পরকে নেক কাজ ও পরহিযগারীর মধ্যে সাহায্য কর, পাপ ও শত্রুতার মধ্যে সাহায্য করনা।” (সূরা মায়িদা-২)
(গ) আর যে সমস্ত খেলা কুফরী ও হারাম কোনটিই নয় কিন্তু প্রকাশ্যে তা পাপ বলেও মনে হয়না, মানুষ সাধারণভাবে সে সমস্ত খেলাকে জায়িয মনে করে থাকে, প্রকৃতপক্ষে তাও পাপেরই অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ মাকরূহ। এতে যেমন ইবাদত-বন্দিগীর ব্যাঘাত ঘটে এবং স্বাস্থ্য, সময় ও টাকা-পয়সার অপচয় হয়, তদ্রুপ পরস্পরের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষও পয়দা হয়।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ان المبذرين كانوا اخوان الشيطين.
অর্থ: “নিশ্চয়ই (সর্বপ্রকার) অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই।” (সূরা বণী ইসরাঈল-২৭)
আর হাদীছ শরীফে বর্ণিত হয়েছে, عن على بن حسين عليه السلام قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من حسن اسلام المرء تركه ما لايعنيه.
অর্থ: “হযরত আলী ইবনে হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, নবী করিম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, কোন ব্যক্তির জন্য দ্বীনের সৌন্দয্য হলো অহেতুক বা অপ্রয়োজনীয় কাজ-কর্ম থেকে বিরত থাকা।” (তিরমিযী, মিশকাত)
উল্লেখ্য যে, শরীয়তের ফতওয়া হচ্ছে- যে কাজ হারাম ও কুফরী, তাকে হালাল মনে করা কুফরী। অর্থাৎ যে হালাল মনে করবে, সে কাফির বা মুরতাদ হয়ে যাবে। আর যে কাজ হারাম ও কুফরী নয় কিন্তু পাপের কারণ, আর সে পাপকে হালকা বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য মনে করা অর্থাৎ এ ধরণের পাপ করলে কিছু হয়না ইত্যাদি মনে করাটাও কুফরী। উল্লেখ্য, হাদীছ শরীফ বা শরীয়তে যে সমস্ত বিষয়ের অনুমোদন দেয়া হয়েছে, সে সমস্ত বিষয়গুলি প্রকৃতপক্ষে খেলা বলতে যা বুঝায় তার অন্তর্ভুক্ত নয়। অর্থাৎ হাদীছ শরীফে তীর ধনুক চালনা করা, অশ্বকে প্রশিক্ষণ দেয়া, স্ত্রীর সাথে শরীয়ত সম্মত হাসিখুশী করা, সাঁতার কাটা, সূতা কাটা, দৌড় অনুশীলন করা ইত্যাদিকে যদিও শাব্দিক অর্থে খেলা বলা হয়েছে কিন্তু হাক্বীক্বত তা খেলা নয়। কারণ, উল্লিখিত বিষয়ের মধ্যে যেমন দ্বীনী ফায়দা রয়েছে, তেমনি দুনিয়াবী ফায়দাও নিহিত রয়েছে। যেমন- তীর চালনা করা, অশ্বকে প্রশিক্ষণ দেয়া, সাঁতার কাঁটা, দৌড় অনুশীলন ইত্যাদি জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণের অন্তর্ভুক্ত এবং স্বাস্থ্যকে সুঠাম ও বলিষ্ঠ রাখার কারণ। হাদীছ শরীফে উল্লেখ রয়েছে,
★প্রশ্ন-(২) খেলা দেখা কতটুকু জায়িয?
★উত্তর-(২): এর জাওয়াবে বলতে হয় যে, খেলা যেহেতু শরীয়তসম্মত নয় সেহেতু তা দেখাও হারাম।
★প্রশ্ন- (৩) জয় কামনা করে দোয়া করা বা খেলার খবর শুনে খুশি প্রকাশ করা, হাতে তালি দেয়া, শুকরিয়া আদায় করা শরীয়ত সম্মত কিনা?
উত্তর-(৩) এর জাওয়াবে বলতে হয় যে, “কোন দলকে সমর্থন করা বা কোন দলের জয় কামনা করে দোয়া করা বা রোযা রাখা, শুকরিয়া আদায় করা সম্পূর্ণরূপে হারাম ও কুফরী। এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে রয়েছে,عن العرس بن عميرة رضى الله تعالى عنه عن النبى صلى الله عليه وسلم قال اذا عملت الخطيئة فى الارض من شهدها فكرهها كان كمن غاب عنها ومن غاب فرضيها كان كمن شهدها.
অর্থ: হযরত উরস্ বিন উমাইরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন। নবী করিম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “যখন পৃথিবীতে কোথাও কোন পাপ কাজ সংঘটিত হয়, তখন যে ব্যক্তি উক্ত স্থানে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও উহাকে ঘৃণা করে, সে ব্যক্তি এরূপ যেন উহা হতে দূরে ছিল। আর যে ব্যক্তি দূরে থেকেও উক্ত পাপের প্রতি সন্তুষ্ট থাকে, সে এরূপ যেন তথায় উপস্থিত ছিল।” (আবূ দাউদ, মিশকাত)।
অর্থাৎ গুণাহ্ কাজ যে স্থানেই সংঘটিত হোক না কেন, তাতে যে ব্যক্তি সম্মতি পেশ করবে অথবা সমর্থন করবে, সে ব্যক্তিই সেই গুণাহে গুণাহ্গার হবে। সেখানে তার উপস্থিত থাকা বা না থাকা উভয়টাই বরাবর। আর সাধারণ মানুষের মধ্যে যারা শুধু রেডিওতে খেলার খবর শুনেছে, টেলিভিশনে খেলা দেখেছে, তারা সকলেই কবীরা গুণাহে গুণাহ্গার হবে। এবং তাদের মধ্যেও দু’শ্রেণী হবে। এক শ্রেণী- যারা হারাম ও নাজায়িয মনে করে শুনেছে ও দেখেছে, তারা ফাসিকের অন্তর্ভুক্ত। আর যারা হালাল ও জায়িয মনে করে শুনেছে ও দেখেছে, তাদের উপরও কুফরীর ফতওয়া বর্তাবে। এরপর যারা খেলার সংবাদ শুনে খুশী প্রকাশ করেছে, তারা সকলেই কবীরা গুণাহে গুণাহ্গার হবে। তারাও দু’শ্রেণীর অন্তর্ভুক্তঃ
(১) যারা হারাম ও নাজায়িয মনে করে খুশী প্রকাশ করেছে, তারা ফাসেক হবে। আর
(২) যারা হালাল ও জায়িয মনে করে শোকর আদায় করেছে ও খুশী প্রকাশ করেছে, তাদের উপরও কুফরীর ফতওয়া বর্তাবে।
এছাড়া যারা রং ছিটিয়ে খুশী প্রকাশ করেছে এমনকি রং ছিটাতে গিয়ে কাদা মাটি ও নোংরা পানি পর্যন্ত ছিটিয়েছে। এরা সকলেই কবীরা গুনাহে গুনাহগার হবে। তারাও দুই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্তঃ
(১) যারা হারাম ও নাজায়িজ মনে করে রং কাদামাটি ও নোংরা পানি ছিটিয়েছে তারা ফাসিক হবে।
(২) যারা হালাল ও জায়িয মনে করে রং, কাদামাটি ও নোংড়াপানি ছিটিয়েছে তাদের উপর কুফরীর ফতওয়া বর্তাবে। যারা রং ছিটিয়ে খুশী প্রকাশ করেছে তাদের কাজটি হিন্দু সম্প্রদায়ের হলি পূজার অনুরূপ হয়েছে। যার ফলে তাদের হাশর-নশরও হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছৈ,
عن عبد الله بن عمر رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من تشبه بقوم فهو منهم.
অর্থ: হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে ওমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করিম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাথে মিল রাখে, সে তাদের দলভুক্ত এবং তার হাশর-নশর তাদের সাথেই হবে।” (মুসনদে আহমদ, সুনানে আবূ দাউদ)
যারা খেলা দেখে খুশী হয়ে হাতে তালি দিল তারা সকলেই কবীরা গুণাহে গুণাহ্গার হবে। তাদের মধ্যে দু’শ্রেণী হবে।
(১) যারা নাজায়েয জেনে হাতে তালি দিয়েছে তারা ফাসিকের অন্তর্ভূক্ত হবে,
(২) আর যারা জায়েয মনে করে দিয়েছে তাদের উপর কুফরীর ফতওয়া বর্তাবে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন