ইসরাইলি পন্য বয়কট করতে চাইলে ভোক্তা পর্যায়ে নয় আগে মুসলিম উদ্দোক্তাদের উদ্দোগ নিতে হবে। আর ভোক্তাদের জানতে হবে অমুসলিমদের প্রতারণা ও পন্যের ক্ষতিকর বিষয়গুলো সম্পর্কে।
পৃথিবীর কোথাও যখন কোন দেশ মুসলমানদের উপর আঘাত হানে (ঈমানে অথবা স্বশরীরে) তখন সে দেশের পন্য বয়কটের প্রচারণা চাউর হয়। যেমন ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, ইন্ডিয়া ইত্যাদি দেশগুলো প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটায়। তখন এ দেশগুলোর পন্য বয়কট করার আহবান সোশ্যাল মিডিয়া খুব প্রচার হয়। যদিও সেই আহবান খুব বেশি ফলপ্রসু হয়না। সম্প্রতি গাজার মুসলমানদের উপর দখলদার ইসরায়েলী হামলার নিন্দা ওঠেছে বিশ্বজুড়ে। মুসলিম দেশগুলোতে ইসরায়েলী পন্য বয়কটের ডাক উঠেছে। কিন্তু এ ডাক কতটা সফল হবে তা নির্ভর করছে ব্যবসায়ীদের উপর, ভোক্তাদের উপর নয়।
মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে যত পণ্য সামগ্রী প্রয়োজন তার সব কিছুই বাজারজাত করেছে ইহুদীরা। যার কারণে তারা সংখ্যায় কম হলেও গোটা বিশ্ব বাজার তাদের দখলে। কিন্তু তাই বলে এমন নয় যে বাজারের সমস্ত পণ্য ইহুদীদের। বাজারে খ্রিস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান সবার পণ্যই আছে। ইসরাইলি পন্য বয়কট করতে হলে মুসলমানদেরকে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে হবে। মুসলমানদের ব্রান্ডগুলো গ্লোবাল মার্কেটিং করতে হবে এবং পন্যগুলো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে হবে। তাহলে বিশ্বব্যাপী মুসলিম ভোক্তাগণ ইসরাইলের পন্যের বিকল্প হিসেবে মুসলমানদের পন্য ক্রয় করবে।
ইসরায়েল-আমেরিকা ও তাদের সাহায্যপ্রাপ্ত নামিদামী ব্রান্ডগুলো যেভাবে প্রতারণা করছে-
বর্তমান বিশ্বে ৬০০কোটি মানুষের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়। তাই অমুসলিমরা অতি কৌশলে মুসলমানদের জন্য হারাম বা নিষিদ্ধ বিষয়গুলি উপাদানের বর্ণনায় গোপন রাখে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় কোকাকোলা। একটি গ্লোবাল প্রোডাক্ট, যা বিশ্বের সব দেশে বাজারজাত হয়। কিন্তু এর উৎপাদনকারীরা এর মধ্যে অ্যালকোহল মিশ্রণের তথ্যটি বেপরোয়া ভাবে এতটা বছর গোপন রেখেছিল। এমন সময় বিষয়টি প্রকাশ করলো যখন অবস্থা এমন যে কোকাকোলা ছাড়া মুসলমানদের দিনগুলো যেনো ফ্যাকাশে। এখন কোকে আসক্ত মুসলমানরা অ্যালকোহল জানার পরেও কোক ছাড়তে পারছেনা। আর এটা যে স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর তা জানার জন্য গুগলে ‘কোকাকোলা খেলে কি হয়’ এতটুকু লিখে সার্চ করলেই ফলাফল চলে আসবে।
বলা বাহুল্য, অমুসলিমদের বিজনেস পলিসিকে ইথিক্যাল বলার সুযোগ নেই। তারা অধিকাংশ পণ্যের বিজ্ঞাপনে মিথ্যাকে অতি রঞ্জিত করে প্রচার করে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যাক হরলিক্সের কথা। টিভি বিজ্ঞাপন দেখে দেখে একথা সবার মুখস্ত হয়ে গেছে যে হরলিক্স খাওয়া বাচ্চারা অন্যান্য বাচ্চাদের চাইতে দ্রুত লম্বা হয়, বেশি শক্তিশালী হয় এবং মেধাবী হয়। উৎপাদনকারী যদি হয় GSK (GlaxosmithKlien) এর মত প্রতিষ্ঠান, তবে কে যাবে এর সত্যতা নিয়ে নাক গলাতে। দক্ষিণ এশিয়াতে এই বিজ্ঞাপন দিয়ে GSK’র ব্যাবসা ভালই চলছিল। শুধুমাত্র ভারতে এই একটি পণ্য বিক্রির রাজস্ব ১ হাজার কোটি রুপি ছাড়িয়ে ছিল। আদতে এটি যে ভুয়া তথ্য সেটি ধরা পড়ে ব্রিটিশ Advertising Standard Authority (ASA) এর কাছে। ব্রিটিশ একটি স্কুলে নির্দিষ্ট বয়সের বাচ্চাদের ২টি গ্রুপ করা হয়। ১টি গ্রুপকে নিয়মিত হরলিক্স খাওয়ানো হয়। নির্দিষ্ট সময়ের পরে হরলিক্স খাওয়ানো বাচ্চাদের পরীক্ষা করে দেখা গেলো GSK’র দাবি অনুযায়ী ওই বাচ্চাদের লম্বা হওয়া, শক্তি বৃদ্ধি পাওয়া এবং মেধা তীক্ষ্ণ হওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এরপর হরলিক্সের এই বিজ্ঞাপন নিয়ে ব্রিটিশ টিভিতে ব্যাপক সমালোচনা হয়। খবরটি ২০০৮ সালে ইকোনমিক টাইমস থেকে নেয়া। (link: https://economictimes.indiatimes.com/top-trending-products/news/amazon-sale-2023-best-deals-on-acs-refrigeratorswashing-machines-tvs-and-kitchen-appliances/articleshow/104404717.cms)
প্রসঙ্গ ছিল অমুসলিমদের বিজনেস ইথিক্স নিয়ে। উদাহরণ অনেক আছে , তবে বিশ্ব বাজারে Procter & Gamble (P&G) এর মত দাপুটে কোম্পানির শ্যাম্পু সম্পর্কে আর কসমেটিকস জগতে সবচেয়ে বড় ও আধিপত্য বিস্তারকারী ফ্রান্সের কোম্পানি L’Oréal এর চেপে রাখা সত্য উন্মোচিত না করলে জাতী আমাকে ক্ষমা করবেনা।
P&G এর ২০২১ সালে উৎপাদিত Dove Dry Shampoo, Nexxus Dry Shampoo, Suave Professionals Dry Shampoo এর মতো 30 টিরও বেশি এ্যারোসল স্প্রে হেয়ার কেয়ার পন্যে, অনেকগুলো ড্রাই শ্যাম্পু ও ড্রাই কন্ডিশনার পণ্যে Benzene নামক ভয়াবহ ক্ষতিকর উপাদান পাওয়া যায়। এই Benzene মানব দেহে leukemia ও blood cancer এর মত ভয়াবহ ক্যান্সার কোষ তৈরি করতে সক্ষম। এটি ধরা পরে ২০২২ সালের অক্টোবরে। ততোদিনে লাখ লাখ মানুষের দেহে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী Benzene ঢুকে গেছে। একই benzene উপাদান পাওয়া গেছে বিশ্ব নন্দিত কয়েকটি ব্র্যান্ডের মশলা, ডিওডোরেন্ট ও বডি স্প্রে তেও, যে ব্র্যান্ডগুলোর নাম মিডিয়া প্রকাশ করেনি।
ফ্রান্সের L’Oréal বিশ্বের সচেয়ে বড় কসমেটিক কোম্পানি। তাদের হেয়ার স্ট্রেইটনার কসমেটিক পণ্যে এমন কেমিক্যাল পাওয়া গেছে যা ত্বকের মাধ্যেমে দেহের ভেতর প্রবেশ করে নারীদের দেহে uterine cancer (জরায়ু ক্যান্সার) ক্যান্সার হওয়ার ঝুকি বাড়িয়ে দেয়। জরায়ু ক্যান্সার থেকে কেউ হায়াতের কারণে মৃত্যু থেকে রক্ষা পেলেও সে আজীবনের জন্য সন্তান ধারণে অক্ষম হয়ে যায়।
(খবর CNN, লিংক: https://www.cnn.com/2022/10/24/business/unilever-shampoo-recall/index.html)
তাই যারা ধর্মপ্রাণ বা সচেতন মুসলিম তারা অমুসলিমদের পণ্যগুলো সতর্কতার সাথে পরিহার করে। আমি অভজারভেশন করে দেখেছি। তাদের মধ্যে অনেকে বিদেশি পণ্য কেনার আগে পণ্যটির লেবেল খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে, আগে দেখে এটা কোন দেশের পণ্য। অমুসলিম দেশের হলে উনারা বিকল্প পণ্য খোঁজেন।
মুসলমানদের ব্রান্ড হিসেবে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে যে প্রতিষ্ঠানটি-
রাজধানীর মালিবাগ মোড়ের কাছে একটি ইসলামী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। নাম আন্তর্জাতিক সুন্নত প্রচার কেন্দ্র। ঢাকায় যারা থাকেন রাস্তায় বিভিন্ন সময়ে তাদের ভ্রাম্যমাণ গাড়ি দেখতে পাবেন, যেখানে তারা মধু, তীন, জয়তুন, সিরকা ইত্যাদি বিভিন্ন সুন্নতী খাদ্য দ্রব্য বিক্রি করে থাকে। তাদের এখানে একটি দোকান রয়েছে যেটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ও মুদি দোকানের সমন্বয়ে মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন দেশী-বিদেশী পন্য সামগ্রী বিক্রি করে থাকে। আমি প্যারাসুট নারকেল তেল খুঁজলাম, সেলসম্যান বললেন- দুঃখিত আমরা ভারতীয় পন্য বিক্রি করিনা, আপনি চাইলে দেশী পন্য নিতে পারেন, কিউট নারকেল তেল আছে, হাঁসমার্কা নারকেল তেল আছে। সেখানে আরো কিছুক্ষণ সময় নিয়ে দেখলাম শুধু ভারতীয় পন্য নয়, সেখানে ইউনিলিভার, স্কয়ার, প্রাণ-আরএফএল এর কোন পন্যও নেই। কথা বলে জানতে পারলাম উনাদের নীতি হচ্ছে প্রয়োজনীয় পন্য সর্বপ্রথম মুসলমানদের উৎপাদিত পন্য খোঁজ করে থাকেন। প্রতিটি পন্যেরই বিকল্প আছে। এমন কোন হালাল পন্য নেই যা মুসলমানরা তৈরী করে না। যেহেতু প্রাণ-আরএফএল কাদিয়ানীদের কোম্পানী, স্কয়ার-এর মালিক খ্রিস্টান আর ভারত তো মুশরিকদের দেশ তাই তাদের পন্য কেনা-বেচা করেন না। প্রশ্ন করলাম- করলে কি সমস্যা? তারা সেলসম্যান কুরআনের একটি আয়াত শোনালেন। অর্থ বললেন- তোমরা নেক ও পরহেজগারীতে সাহায্য সহযোগীতা কর, পাপ ও বদীতে সাহায্য সহযোগীতা করোনা। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ উনাকে ভয় কর, নিশ্চয় তিনি কঠিন শাস্তি দাতা।
এরপর বললেন হযরত সাহাবায়ে কেরাম উনাদের নীতি ছিলো যখন কোন কিছু কেনার প্রয়োজন হতে তখন সর্বপ্রথম নিজেদের মধ্যে অর্থাৎ মুসলমানদের মধ্যে তা খোঁজ করতেন। না পাওয়া গেলে বিকল্প খোঁজ করতেন। সেটাও না পাওয়া গেলে যদি নিতান্তই প্রয়োজন হয় তখন অমুসলিমদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতেন।
কারন আপনি আমার কাছ থেকে পন্য কিনছেন মানে আমাকে কিছু মুনাফা দিচ্ছেন। এই মুনাফা দিয়ে ব্যবসায়ীরা কি করে? কিছু অংশ ব্যবসার প্রয়োজনে খরচ করে, কিছু অংশ তার পরিবারের জন্য খরচ করে, আর কিছু তার ধর্মীয় কাজে ব্যয় করে। এখন আপনি যদি অমুসলিমদের কাছ থেকে পন্য কিনেন, তাহলে সেই পন্যের মুনাফা দিয়ে সে কুফরি শিরকী কাজে ব্যায় করবে। এছাড়াও তারা উপার্জনের একটা বড় অংশ ব্যায় করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে, মুসলমানদের ক্ষতি করার জন্য। তাহলে আপনি তাকে কুফরি শিরকী কাজে সাহায্য সহযোগীতা করলেনই সাথে সাথে আত্মঘাতী কাজে খরচ করলেন। আল্লাহ পাক বলে দিলেন, এ ব্যাপারে তোমরা মহান আল্লাহ পাক উনাকে ভয় কর, নিশ্চয়ই তিনি কঠিন শাস্তি দাতা। তাহলে একজন মুসলমানের জন্য কিভাবে সম্ভব কাফির মুশরিকদের পন্য ক্রয় করা। এই কারণেই আমরা কাফিরদের পন্য ক্রয় করিনা, বিক্রিও করিনা।
জানতে চাইলাম তাহলে প্রসাধনী পন্য কাদেরটা বিক্রি করছেন? সেলসম্যান বললেন, আমাদের নিজস্ব প্রসাধনী পন্য রয়েছে। আমাদের নিজস্ব ল্যাবরেটরী ও ফ্যাক্টরী আছে। আমাদের প্রসাধনী পন্যগুলো সুন্নতী উপাদান নির্ভর। যেমন আমাদের শ্যাম্পু জয়তুন, এ্যালোভেরা নির্যাস থেকে তৈরী। আমাদের বডিওয়াশ আছে যেটা বড়ই পাতার নির্যাস থেকে তৈরী। এছাড়া আমাদের এন্টি এজিং ক্রীম রয়েছে যেটা শুধুমাত্র মৌমাছির মোম ও জয়তুন তেল দিয়ে তৈরী হয়। আমাদের ফুড প্রডাক্টগুলোও প্রিজারভেটিভ মুক্ত। ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা সম্পূর্ণ নিষেধ। শুধুমাত্র BSTI অনুমোদিত পন্যগুলোই আমরা বিক্রি করে থাকি।
সবকিছু জেনে প্রতিষ্ঠানটি আমার কাছে দৃষ্টান্তমূলক মনে হয়েছে। মুসলমানদের ব্যবসা করতে হলে এভাবেই করা উচিত। তাহলে ইসরাইলি পন্য নয়, গোটা অমুসলিদের পন্যই বয়কট করা যাবে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন