‘ফেসবুক’ সোশ্যাল নেটওয়ার্কের নামে ভয়ঙ্কর আনসোশ্যাল ক্রিমিনাল তথা পর্নো ক্রাইম তৈরির উর্বর পটভূমি। শুধু মুসলিম বিশ্বেই নয়; অমুসলিম বিশ্বেও ফেসবুকের বিরুদ্ধে উঠেছে জোরালো প্রতিবাদ। প্রকাশিত হয়েছে এর হাজারো ভয়ঙ্কর খারাপ দিক। ফেসবুকের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবীরাও। তবে এটাও মূল সত্য যে, ফেসবুকের মিশন হচ্ছে, মুসলমান তরুণ-তরুণীদের চরিত্র নষ্ট করা তথা ইসলাম অবমাননা করা। তবে এটি শুধু এক দোষেই দুষ্ট নয়; বরং সর্বস্তরের বোদ্ধাদের প্রতিবাদের সম্মিলনে ফেসবুকের বিরুদ্ধে তৎপরতা এখন সামাজিক থেকে বৈশ্বিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারকেও এর আঁচ অনুভব করতে হবে এবং এটি বন্ধের মানসিকতায় অটুট থাকতে হবে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের প্রতি সংহতি সমুন্নত রাখতে হবে।
ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষের ভেতরে মানবিক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বলয় তৈরিকে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক বলে। ৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই ইন্টারনেটভিত্তিক সোশ্যাল নেটওয়ার্ক তৈরি কাজের সূচনা হয়। WELL (১৯৮৫), Theglobe.com (১৯৯৪), Geocities (১৯৯৪) Tripod.com (১৯৯৫) ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান প্রথম এই উদ্যোগ নেয়। Classmates.com নামের একটি ওয়েবসাইট ১৯৯৫ সালে প্রথম ওয়েবসাইটের মাধ্যমে পুরনো স্কুল বন্ধুদের খুঁজে বের করার একটি পথ বের করে। তারপর ১৯৯৭ সালে একই ধরনের কাজে হাত দেয় SixDegrees.com নামের আরেকটি ওয়েবসাইট। এই সাইট ব্যবহারকারীরা প্রথম বন্ধু তালিকা তৈরি, প্রোফাইল তৈরি এবং মেসেজ পাঠানোর সুযোগ পায়। কিন' আজকের মতো সেদিনের অবস্থা ছিল না। এজন্য SixDegrees.com -কে আর্থিক লোকসান গুণতে হয়। শেষে সাইটটি বন্ধ হয়ে যায়। একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই ইলেক্ট্রনিক সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং দুনিয়ায় একের পর এক বিপ্লব ঘটতে থাকে। ২০০৩ সালে মাইস্পেস ও লিংকডইনের মতো সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইটের জন্ম হয় এবং ২০০৪-এ আসে ফেসবুক। ২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আমেরিকায় ফেসবুকের জন্ম হয়েছিল ইন্টারনেটে কলেজ ছাত্রদের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে ও একসঙ্গে যুক্ত থাকতে। ৪ জন মিলে ফেসবুক প্রতিষ্ঠা করে। এরা হলো- মার্ক জুকারবার্গ, ইডুয়ারডো সেভেরিন, ডাসটিন মোসকোভিটস ও ক্রিস হার্জস। দেখা গেলো, ফেসবুক জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হার্ভার্ডের ১ হাজার ২শ’ ছাত্রছাত্রী এর সঙ্গে যুক্ত হলো। অল্প সময়ের ভেতরেই অন্যান্য স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এর ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ ইবলিস এটাকে বর্তমান যুগে তার মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে লুফে খুব দ্রুত এর প্রচার-প্রসার ঘটায়। যুক্তরাজ্যের টেলিগ্রাফ পত্রিকা লিখেছে, ফেসবুককে facebook.com -এই ডোমেইন নাম কিনতে এবং নিবন্ধন করতে খরচ করতে হয়েছিল ২ লাখ ডলার। ফেসবুকের আন্তর্জাতিক সদর দপ্তর ডাবলিনে। গত বছরের মে মাসে ফেসবুকে ২০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করার ঘোষণা দেয় একটি রুশ প্রতিষ্ঠান। এর ফলে প্রতিষ্ঠান হিসেবে ফেসবুকের মূল্য দাঁড়ায় ১ হাজার কোটি ডলার! ফেসবুক বোর্ডের সদস্য মার্ক আন্দ্রিসেন এ বছরের শুরুর দিকে বলেছিলো, এ বছর ফেসবুকের রাজস্ব ৫০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। ফেসবুক সম্পর্কে আরো যা প্রচারিত তথ্য তাহলো- * ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৪শ’ মিলিয়ন। * প্রতি মাসে নতুন ভিজিটরের সংখ্যা ২ কোটি ৫০ লাখ। * ফেসবুক ব্যবহারকারীরা দৈনিক প্রায় ১৮ বিলিয়ন মিনিট ফেসবুকের পেছনে ব্যয় করে। * ব্যবহারকারীরা তার পেজে দৈনিক ৪৫ মিলিয়ন স্ট্যাটাস লেখে। * প্রতিদিন ১০ মিলিয়ন ব্যবহারকারী ‘become a fan pageÕ ব্যবহার করে। * প্রতিমাসে প্রায় ২ বিলিয়ন ছবি এবং ১৪ মিলিয়ন ভিডিও ব্যবহারকারীরা আপলোড করে। * ব্যবহারকারীরা প্রতি মাসে ৩ মিলিয়ন ‘ইভেন্ট’ তৈরি করে। * প্রতিদিন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪৫ মিলিয়ন। * এতে ব্যবহার করা ভাষার সংখ্যা ৭০। * ৬৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ সেলফোনে ফেসবুক ব্যবহার করে। * ফেসবুকে ৩ লাখ ৫০ হাজার অ্যাকটিভ অ্যাপ্লিকেশন রয়েছে। এদিকে গত শনিবার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আপত্তিকর প্রচারণার অভিযোগে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার দেশে সামাজিক যোগাযোগের সবচেয়ে কথিত ওয়েবসাইট ফেসবুক সাময়িকভাবে বন্ধ (ব্লক) করার নির্দেশ দিয়েছে। বিটিআরসি সূত্র জানায়, কিছু দিন ধরেই ফেসবুকের অপব্যবহারের বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছিল। অভিযোগ আসে, ফেসবুকে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন ব্যক্তির নাম ও ছবি ব্যবহার এবং তাদের সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য প্রকাশ করা হচ্ছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার মতো ঘটনাও ঘটানো হচ্ছে। এসব অভিযোগের ফলে ২৬ মে ম্যাঙ্গো টেলিকম ও বিটিসিএলকে নির্দেশ দেয়া হয়, তাদের পরিচালিত আইআইজি থেকে ফেসবুকের বিশেষ কিছু লিংক বন্ধ করে দিতে। কিন' তারা তা করেনি। এ প্রসঙ্গে বিটিআরসি সূত্রের মন্তব্য হচ্ছে, প্রতিষ্ঠান দুটি হয় কারিগরি দক্ষতার অভাবে অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে নির্দেশটি পালন করেনি। এ অবস্থায় গতকাল বিকেলে ফেসবুক পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। চলতি সপ্তাহেই পাকিস্তান সরকার সে দেশে ফেসবুক ও ইউটিউব বন্ধ করে দেয়। নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, উনাকে নিয়ে কার্টুন আঁকার মতো আপত্তিকর প্রতিযোগিতা আয়োজন করার পর এ ব্যবস্থা নেয় পাকিস্তান। ইউরোপের একটি দেশ থেকে এক ব্যক্তি 'এভরিবডি ড্র মুহাম্মদ ডে' নামের ওই প্রতিযোগিতা আহ্বান করে। ফেসবুকের বিরুদ্ধে অনেক কথার মাঝে দু’একটি কথাবার্তা: এখন চাইলেই একজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী যে কারও ইমেইল পাসওয়ার্ড, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের পাসওয়ার্ড, ক্রেডিট কার্ড নম্বর, মোবাইল ফোন নম্বর ইত্যাদি তথ্য হ্যাক করে নিতে পারে। ‘হ্যাকিং সফ্টওয়্যার’ বাজারে পানির দামে বিক্রি হয়। বর্তমানে হ্যাকিং ক্রাইম সবচেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে ফেসবুক ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে। আগে বড় বড় হ্যাকার বড় বড় প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন জরুরি ও গোপনীয় তথ্য হ্যাক করত, বর্তমানে ছোট ছোট হ্যাকার হ্যাক করছে মানুষের ছোট ছোট গোপনীয় তথ্য। এ ধরনের হ্যাকিং সহজ হলেও লাভ অনেক, এভাবে হ্যাকার যে কাউকে সহজেই ব্ল্যাকমেইল ও হয়রানি বা মানহানি করতে পারে। বর্তমানে হ্যাকিংয়ের সবচেয়ে সহজ উপায়, হ্যাকার কোনও চমকপ্রদ বা আকর্ষণীয় অফারসহ একটি লিংক কারও ফেসবুক জাতীয় সাইটে রেখে দেয়। প্রস্তাবে আগ্রহী ব্যক্তি ওই লিংক অনুসরণ করে হ্যাকারের নির্ধারিত ওয়েবসাইট পৌঁছে। যেখানে বলা থাকে, অফার গ্রহণ করতে আগ্রহী ব্যক্তিকে ‘সাইন আপ’ করতে হবে। অর্থাৎ অন্তত ই-মেইল অ্যাড্রেস ও পাসওয়ার্ড উল্লেখ করে নিবন্ধন করতে হবে। আগ্রহীরা তাই করে বসেন। হ্যাকার এভাবেই পেয়ে যান ফাঁদে পা দেওয়া ব্যক্তির ই-মেইল অ্যাকাউন্ট ও সামাজিক যোগাযোগ ওয়েবসাইট অ্যাকাউন্টে ঢোকার চাবি। তাই হ্যাকারদের হাত থেকে বাঁচতে অবাঞ্ছিত ও সন্দেহজনক লিংক, অফার, মেসেজ ও ওয়েবসাইটকে এড়িয়ে চলুন। এ তো গেল হ্যাকিংয়ের বিষয়। হ্যাকিং ছাড়াও অন্যান্য, যেমন- ব্ল্যাকমেইলিং, যৌন হয়রানি, উত্ত্যক্ত করা ইত্যাদি সাইবার ক্রাইমও দিন দিন সামাজিক সমস্যা হিসাবে আবির্ভূত হচ্ছে। গণসচেতনতা, সময়োপযোগী আইন প্রণয়ন এবং ফেসবুক জাতীয় ওয়েবসাইট কর্তৃপক্ষের নজরদারিই এসব সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারে। নিচে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটভিত্তিক সাইবার ক্রাইম সংক্রান্ত কিছু তথ্য ও ঘটনা তুলে ধরা হলো। (১) এ বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি স্বয়ং ব্রিটিশ কেবিনেট মন্ত্রী এড মিলিব্যান্ড হ্যাকারদের শিকার হন। মন্ত্রীর টুইটার অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে কে বা কারা তার সাড়ে ৬ হাজার বন্ধু ও সহকর্মীকে অশ্লীল মন্তব্য সংবলিত টুইট বা মেসেজ পাঠিয়ে দেয়। মেসেজের সঙ্গে ছিল মন্ত্রীর একটি সহাস্য ছবি। এ নিয়ে পুরো ব্রিটেনে তোলপাড়। সংবাদমাধ্যমগুলো উঠেপড়ে লাগে। পরে সবাই জানতে পারে মেসেজটি মন্ত্রী পাঠাননি। (সূত্র : ব্রিটিশ পত্রিকা দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট) (২) মাইকেল রেমোসের বয়স ৪৮ বছর। তার কাজ হলো মাইস্পেসের মাধ্যমে অল্পবয়সী মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা। শারীরিক সম্পর্কই তার লক্ষ্য। একদিন সে মাইস্পেসে পেয়ে যায় একটি ১৫ বছর বয়সী মেয়েকে। মেয়েটির সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। এক পর্যায়ে রেমোস মেয়েটিকে তার সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কে জড়ানোর প্রস্তাব করে, যা পুরোপুরি বেআইনি। কেননা মেয়েটি নাবালিকা। রেমোস জানত না, এটি এক দল ছেলের তৈরি ফাঁদ। মেয়েটি কাল্পনিক, কয়েকজন বন্ধু মিলে স্রেফ মজা করার জন্যই ১৫ বছরের মেয়ের নামে নকল অ্যাকাউন্ট খোলে। যাহোক, রেমোসের প্রস্তাবে রাজি হয় কাল্পনিক মেয়েটি, তারা দেখা করার জন্য দিনক্ষণও ঠিক করে, রেমোস যখন মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে আসে তখন ওই ছেলেগুলো রেমোসকে প্রমাণসহ পুলিশের হাতে তুলে দেয়। (সূত্র : এপি) (৩) অ্যান'নি স্টাঙ্কল। ১৮ বছর বয়সী এই মার্কিন যুবককে ২০০৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার করা হয়। সহপাঠিনীদের আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও কিপ ফেসবুকে আপলোড করে তাদের ব্ল্যাকমেইল করত। সে হুমকি দিত, মেয়েরা যদি তার যৌনসঙ্গী না হয় তাহলে ছবিগুলোকে আরও ছড়িয়ে দেওয়া হবে। এমন ৩১ জনকে সে ও তার সহযোগীরা হুমকি দেয়। অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় তাকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। (সূত্র : এপি) (৪) মরক্কোর মেয়েরা ফেসবুকে তাদের দেশের যুবরাজকে পেয়ে খুশিতে আটখানা। সবাই তাকে পেতে কাঠখড় পোড়ানো শুরু করল, কিন' তাদের সব আয়োজন ভেঙে গেল যখন পুলিশ তাদের জানাল যুবরাজ আইডি জালিয়াতের শিকার হয়েছেন। অর্থাৎ এতদিন ফেসবুকে ২৬ বছর বয়সী ফুয়াদ মুরতাদা নামে এক যুবক যুবরাজের নামে নকল অ্যাকাউন্ট খুলে মেয়েদের মন জয় করছিল। আইডি জালিয়াতির অভিযোগে ফুয়াদকে ৪৩ দিনের কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। (সূত্র : সিএনএন) (৫) মিলি (ছদ্মনাম) স্বামী আর এক বাচ্চা নিয়ে বসবাস করেন ইউরোপের একটি দেশে। মিলির সঙ্গে ঢাকার এক মিডিয়াকর্মী আরমানের (ছদ্মনাম) ফেসবুকে পরিচয়। সম্পর্ক বন্ধুত্ব থেকে প্রেমে গড়ায়। এখনও প্রেম চলছে, পাশাপাশি চলছে পরিকল্পনা। মিলি ও আরমান ঠিক করেছেন, মিলি বাচ্চাসহ হঠাৎ একদিন ঢাকা চলে আসবেন। ঢাকা থেকে মিলি স্বামীকে পাঠিয়ে দেবেন ডিভোর্স লেটার, ব্যস। আরমান কথা দিয়েছে বাচ্চাসহই মিলিকে বিয়ে করবেন। আরমান নতুন একটি ফ্ল্যাটও দেখে রেখেছেন। (ইনশাআল্লাহ চলবে)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন