পবিত্র সুন্নত অর্থ ও পরিচয়ঃ
السنة (সুন্নত) শব্দটি আরবী, একবচন। বহুবচনে السنن (সুনান)। আভিধানিক অর্থ হল, الطريقة والسيرة অর্থাৎ পথ, পন্থা, পদ্ধতি, রীতি, নিয়ম ইত্যাদি; (লিসানুল আরব১৩/২২৪-২২৫)
মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে উক্ত অর্থে সুন্নত শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তিনি ইরশাদ মুবারক করেন,
يُرِيْدُ اللهُ لِيُبَيِّنَ لَكُمْ وَيَهْدِيَكُمْ سُنَنَ الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَيَتُوْبَ عَلَيْكُمْ وَاللهُ عَلِيْمٌ حَكِيْمٌ
তথা মহান আল্লাহ পাক তিনি ইচ্ছা করেন তোমাদের নিকট বিশদভাবে বিবৃত করতে, তোমাদের পূর্ববর্তীদের রীতি-নীতি এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করতে। মহান আল্লাহ পাক সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়’ (পবিত্র সূরা নিসা শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ২৬)
মহান আল্লাহ পাক তিনি আরো ইরশাদ মুবারক করেন-
سُنَّةَ اللهِ فِيْ الَّذِيْنَ خَلَوْا مِنْ قَبْلُ وَلَنْ تَجِدَ لِسُنَّةِ اللهِ تَبْدِيْلاً
অর্থ: মহান আল্লাহ পাক তিনি নিজের বিধান বা নিয়ম জারী রেখেছেন ঐ সকল লোকদের মধ্যেও যারা পূর্বে অতীত হয়ে গেছে। আপনি কখনো মহান আল্লাহ পাক উনার নিয়ম বা বিধানে কোন পরিবর্তন পাবেন না’ (পবিত্র সূরা আহযাব শরীফ; পবিত্র আয়াত শরীফ ৬২)।
সম্মানিত ইসলামী শরীয়তে ‘সুন্নাহ’ অর্থ নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সামগ্রিক জীবনাদর্শ। (কাশফুল আসরার আলা উসূলিল বাযদাবী২/৬৫৯)
নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সামগ্রিক জীবন পদ্ধতিই সুন্নত। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যে কাজ ফরয হিসেবে করেছেন তা ফরয হিসেবে করা সুন্নত। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যা নফল হিসেবে করেছেন তা নফল হিসেবে করা সুন্নত। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যা নিয়মিতভাবে করেছেন তা নিয়মিতভাবে করাই সুন্নত। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যা মাঝে মাঝে করেছেন তা মাঝে মাঝে করা সুন্নত। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা কখনো করেননি, অর্থাৎ সর্বদা বর্জন করেছেন তা সর্বদা বর্জন করাই সুন্নত।
সংক্ষেপে বলা যায় নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পালনীয় কর্ম ও বর্জন হুবহু অনুকরণ করাই পবিত্র সুন্নতমুবারক উনার অন্তর্ভুক্ত।
নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উক্ত একই অর্থে সুন্নত শব্দের ব্যবহার করেছেন। যেমন তিনি ইরশাদ মুবারক করেন,
مَنْ سَنَّ فِيْ الإِسْلاَمِ سُنَّةً حَسَنَةً فَعُمِلَ بِهَا بَعْدَهُ كُتِبَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِ مَنْ عَمِلَ بِهَا وَلاَ يَنْقُصُ مِنْ أُجُوْرِهِمْ شَىْءٌ وَمَنْ سَنَّ فِيْ الإِسْلاَمِ سُنَّةً سَيِّئَةً فَعُمِلَ بِهَا بَعْدَهُ كُتِبَ عَلَيْهِ مِثْلُ وِزْرِ مَنْ عَمِلَ بِهَا وَلاَ يَنْقُصُ مِنْ أَوْزَارِهِمْ شَىْءٌ-
অর্থ: ‘যে ব্যক্তি সম্মানিত দ্বীন ইসলামের মধ্যে কোন উত্তম রীতি চালু করবে সে তার প্রতিদান পাবে এবং তার দেখাদেখি পরবর্তীতে যারা তা করবে তাদের সমান প্রতিদানও সে পাবে। তবে তাদের প্রতিদান থেকে কোন কিছুই কম করা হবে না। আর যে ব্যক্তি দ্বীন ইসলামে কোন মন্দ রীতি চালু করবে সে তার কাজের পাপ পাবে ও তার দেখাদেখি পরবর্তীতে যারা তা করবে তাদের সমান পাপের অধিকারীও হবে। তবে তাদের পাপ থেকে কোন কিছুই কম করা হবে না’।
পবিত্র সুন্নাত উনার পরিভাষিক অর্থে বলা হয়:
مَا نُقِلَ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم مِنْ قَوْلٍ أَوْ فِعْلٍ أَوْ تَقْرِيْرٍ وَعَلَى مَا جَاءَ عَنِ الصَّحَابَةِ أَوْ الخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ
অর্থ: ‘সুন্নত হলো নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কথা মুবারক, কর্ম মুবারক ও মৌন সম্মতি মুবারক থেকে যা বর্ণিত হয়েছে এবং যা হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম ও হযরত খুলাফায়ে রাশিদীন আলাইহিমুস সালাম উনাদের পক্ষ থেকে এসেছে’।
কেউ কেউ বলেন,
السُّنَّةُ مَا وَرَدَ عَنِ النَّبيِّ صلى الله عليه وسلم مِنْ قَوْلٍ أَوْ فِعْلٍ أَوْ تَقْرِيْرٍ
অর্থাৎ ‘সুন্নত হল, যা নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কথা, কর্ম ও মৌন সম্মতি থেকে বর্ণিত হয়েছে’।
অতএব, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যা করতে বলেছেন, তা করা সুন্নত, যা তিনি নিজে করেছেন তা করা সুন্নত এবং যা তিনি করতে বলেননি এবং নিজেও করেননি; কিন্তু অন্য কাউকে করতে দেখলে তাকে নিষেধ করেননি, এরূপ মৌনসম্মতিও সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। বিদআত হলো সুন্নাতের বিপরীত। আর নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ইবাদত করতে বলেননি, নিজে করেননি এবং মৌনসম্মতি প্রদান করেননি, এরূপ কাজ যত ভাল দবলে মনে হোক না কেন তা বিদআতের অন্তর্ভুক্ত।
পবিত্র সুন্নত মুবারক উনার প্রকারভেদঃ
নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কথা মুবারক, কর্ম মুবারক ও মৌন সম্মতি মুবারকের অনুসরণ করা যেমন সুন্নত, তেমনি এর বহির্ভূত কাজকে বর্জন করাও সুন্নত। অতএব অনুসরণ ও বর্জনের মাধ্যমে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অনুসরণের ক্ষেত্রে সুন্নত মুবারক দুই প্রকার। যথা-
(এক) السنة الفعلية (সুন্নাতে ফি‘লিয়্যাহ) তথা কর্মে সুন্নত : নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইবাদত হিসাবে যা করেছেন, করতে বলেছেন এবং সম্মতি প্রদান করেছেন তা পালন করা সুন্নত।
মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন,
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا وَاتَّقُوْا اللهَ إِنَّ اللهَ شَدِيْدُ الْعِقَابِ
অর্থাৎ নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যা নিয়ে এসেছেন তা গ্রহণ করুন এবং যা নিষেধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাকুন এবং এ বিষয়ে মহান আল্লাহ পাক উনাকে ভয় করুন। নিশ্চয় মহান আল্লাহ পাক তিনি কঠিন শাস্তিদাতা। (পবিত্র সূরা হাশর শরীফ; পবিত্র আয়াত শরীফ ৭)
অত্র আয়াত শরীফে মহান আল্লাহ পাক উনার স্পষ্ট নির্দেশ হলো, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আনীত বিধানের বাইরে কোন কাজই ইবাদত হিসাবে গ্রহণীয় হবে না। হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনারা প্রত্যেকটি আমল প্রতি পদে মেনে চলেছেন। সুবহানাল্লাহ!
(দুই) السنة الةركية (সুন্নাতে তারকিয়্যাহ) তথা বর্জনীয় সুন্নত : নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ইবাদত করেননি, করতে বলেননি এবং সম্মতি প্রদান করেননি এমন বিয়ষ বর্জন করাই উনার সুন্নত। এককথায় সুন্নত হল নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পন্থা ও আদর্শ মুবারক। চাই তা আক্বীদাগত বা আমলগত হোক। এছাড়া হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের আক্বীদা ও আমলসমূহও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনাদের অন্তর্গত।
পবিত্র সুন্নত কেন অনুসরন করতে হবে?
মহান আল্লাহ পাক উনার হুকুম -
قُلْ
اِنْ كُنْـتُمْ تُـحِبُّـوْنَ اللهَ فَاتَّبِعُوْنِـيْ يُـحْبِبْكُمُ اللهُ
وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُـوْبَكُمْ ۗ وَاللهُ غَفُوْرٌ
رَّحِيْمٌ.
অর্থ: “(হে হাবীব
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!) আপনি বলুন, যদি তোমরা মহান আল্লাহ পাক
উনাকে মুহব্বত করো,
তাহলে আমাকে অনুসরণ করো, যাতে মহান আল্লাহ পাক তিনিও
তোমাদেরকে মুহব্বত করেন এবং তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর মহান আল্লাহ পাক তিনি
হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু।” (পবিত্র সূরা আল ইমরান শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ৩১)
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার
মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-
قَالَ
حَضْرَتْ اَنَسُ بْنُ مَالِكٍ رَضِىَ اللهُ تَـعَالٰى عَنْهُ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ
صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ اَحَبَّ سُنَّتِيْ فَـقَدْ اَحَبَّنِيْ
وَمَنْ اَحَبَّنِيْ كَانَ مَعِيَ فِي الْـجَنَّةِ
অর্থ: “হযরত আনাস ইবনে মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, যে ব্যক্তি আমার সম্মানিত সুন্নত মুবারক উনাকে মুহব্বত করলেন, তিনি মূলতঃ আমাকেই মুহব্বত করলেন, আর যিনি আমাকে মুহব্বত করলেন, তিনি আমার সাথে সম্মানিত জান্নাতে অবস্থান করবেন।” সুবহানাল্লাহ! (মু’জামুল আওসাত ৯ম খণ্ড ১৬৮ পৃষ্ঠা: হাদীছ শরীফ নং ৯৪৩৯; শিফা শরীফ)
. যেহেতু বর্তমান যামানা
আখেরী যামানা। মূলতঃ ১০০০ হিজরী সনের পর থেকেই আখেরী যামানা শুরু হয়ে গিয়েছে। এই
আখেরী যামানায় যে ব্যক্তি একটি সুন্নতী খাদ্য মৃত্যু পর্যন্ত আঁকড়ে থাকবেন তিনি
১০০জন সম্মানীত শহীদ উনাদের সমান ফযীলত মুবারক হাছিল করবেন।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ
শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-
عَنْ
حَضْرَتْ اِبْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ تَـعَالٰى عَنْهُ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى
اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَنْ تَـمَسَّكَ بِسُنَّتِىْ عِنْدَ فَسَادِ
اُمَّتِىْ فَـلَه اَجْرُ مِائَةِ شَهِيْدٍ
অর্থ: “হযরত ইবনে আব্বাস
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নূরে
মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক
করেন, যে ব্যক্তি আমার উম্মতের ফিতনার যামানায় আমার একখানা সম্মানিত সুন্নত মুবারক
দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরবেন,
তিনি ১০০ জন শহীদ উনাদের সমান ছাওয়াব লাভ করবেন।” (মিশকাত
শরীফ)
৩. যেহেতু প্রত্যেকটি
সম্মানিত সুন্নত মুবারক হচ্ছেন এক একটি সম্মানিত নূর মুবারক। আর তাই সম্মানিত
সুন্নতী খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে প্রত্যেক গ্রাসেই নূর মুবারক ভিতরে প্রবেশ করছে।
যার মাধ্যম দিয়ে মুসলমান উনাদের অন্তর প্রশান্ত হচ্ছে।
পক্ষান্তরে কাফির-মুশরিক, ইয়াহুদী-নাছারা, বেদ্বীন-বদ্বীনদের
অনুসরণ করা হারাম। মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-
وَلَا
تُطِعِ الْكَافِرِيْنَ وَالْمُنَافِقِيْنَ
অর্থ: “তোমরা কাফির
মুনাফিক্বদের অনুসরণ করোনা।” (পবিত্র সূরা আহযাব শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ১ ও
৪৮)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন