প্রচলিত ৬ উছূলভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতের লোকদের লিখিত কিতাবে এ কথা উল্লেখ আছে যে, মূর্খ হোক, আলিম হোক, ধনী হোক, দরিদ্র হোক, সকল পেশার সকল মুসলমানের জন্য তাবলীগ করা ফরজে আইন।
(হযরতজীর মালফুজাত-৪, পৃষ্ঠা-৭, অনুবাদক- মাওলানা ছাখাওয়াত উল্লাহ; তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরু দায়িত্ব, পৃষ্ঠা-৫৬, অনুবাদক- ইসমাঈল হোসেন; তাবলীগে ইসলাম, পৃষ্ঠা-৩, লেখক- মাওলানা আব্দুস সাত্তার ত্রিশালী; পস্তী কা ওয়াহিদ এলাজ, লেখক- মাওলানা এহ্তেশামুল হাসান কান্দলবী, পৃষ্ঠা-২২)
———————————————————————————-
তাদের উপরোক্ত বক্তব্যের প্রেক্ষিতে প্রশ্ন জাগে, তাবলীগ করা কি- ফরজে আইন নাকি ফরজে কিফায়া? কেননা- যে ইবাদত প্রত্যেকের জন্য আলাদাভাবে পালন করা ফরজ তা ফরজে আইন। যেমন- নামাজ, রোজা, ইত্যাদি। আর যে ইবাদত সমষ্টিগতভাবে পালন করা ফরজ অর্থাৎ যে ফরজ কাজ দেশবাসী, শহরবাসী,এলাকাবাসী বা কোন সম্প্রদায় থেকে একজন আদায় করলেই সকলের তরফ থেকে ফরজের হক্ব আদায় হয়ে যায় তা ফরজে কিফায়া। যেমন- কুরআনে হাফিজ হওয়া বা আলিম হওয়া, জানাযার নামাজ ইত্যাদি।
উপরোক্ত বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আরো একটি প্রশ্ন জাগে, তাবলীগ করা যদি ফরজে আইন হয়, তবে কার জন্য ফরজে আইন? এবং যদি ফরজে কিফায়া হয়, তবে কার জন্য ফরজে কিফায়া? আর যদি উভয়টাই হয়, তবে সেটাইবা কাদের জন্য?
মূলতঃ তাবলীগ করা ফরজে আইন ও ফরজে কিফায়া উভয়টাই। নীচে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলোঃ
তাবলীগঃ তাবলীগ শব্দের অর্থ হলো প্রচার করা। তাবলীগ সম্পর্কে আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন শরীফে ইরশাদ করেন,
“তোমরা (হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মত হওয়ার কারণে) শ্রেষ্ঠ উম্মত, তোমাদেরকে মানুষের মধ্য হতে বের করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করবে এবং আল্লাহ পাকের প্রতি ঈমান আনবে।” (সূরা আল ইমরান ১১০)
উপরোক্ত আয়াত শরীফের মাধ্যমে আল্লাহ পাক তাবলীগ করা তথা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের কথা বলেছেন। তবে সাথে সাথে আরো একটি শর্তও আরোপ করেছেন, সেটা হলো আল্লাহ পাক ও রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং দ্বীন সম্পর্কে যাবতীয় বিষয়ে সঠিক ও পরিশুদ্ধ ঈমান আনা অর্থাৎ তৎসম্পর্কে বিশুদ্ধ আক্বীদা পোষণ করা। অর্থাৎ তাবলীগ করতে হবে আক্বীদা শুদ্ধ রেখে।
সাধারণভাবে দ্বীন প্রচার করাকে তাবলীগ বলে এবং যিনি দ্বীন প্রচার করেন অর্থাৎ তাবলীগের কাজ করেন তাকে মুবাল্লিগ বা দ্বীন প্রচারক বলে।
তাবলীগ ও মুবাল্লিগের প্রকারঃ সাধারণতঃ ইসলাম বা দ্বীন দুইভাবে প্রচার করা হয়ে থাকে-
১) তাবলীগে আম বা সাধারণভাবে
২) তাবলীগে খাছ বা বিশেষভাবে
আবার তাবলীগের ধরণ অনুযায়ী দ্বীন প্রচারক বা মুবাল্লিগও দুইপ্রকার-
১) মুবাল্লিগে আম বা সাধারণ দ্বীন প্রচারক
২) মুবাল্লিগে খাছ বা বিশেষ দ্বীন প্রচারক
মুবাল্লিগে আম ও তার হিদায়েতের ক্ষেত্রঃ মুবাল্লিগে আম বা সাধারণ দ্বীন প্রচারকের দ্বীন প্রচার করতে বিশেষ কোন যোগ্যতার প্রয়োজন নেই। শুধু দ্বীনি সমঝ বা বুঝ থাকলেই চলবে। তিনি বা তারা খাছ বা বিশেষভাবে যেমন ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী, ভাই-বোন, ভাতিজা-ভাতিজী ও কর্মচারী তথা তার অধীনস্থ সকলকে দ্বীনি আমলের জন্য তথা দ্বীনদারী হাছিলের তাকীদ বা উৎসাহ প্রদান করবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক কালামে পাকে ইরশাদ করেন,
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে আগুন (জাহান্নাম) থেকে বাঁচাও।” (সূরা তাহ্রীম ৬)
আর হাদীস শরীফে রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
“সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই (নিজের অধীনস্থদের ব্যাপারে) রক্ষক এবং প্রত্যেকেই তার রক্ষিত বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত, ফতহুল বারী, ওমাদাতুল ক্বারী, তাইসীরুল ক্বারী, এরশাদুস্ সারী, মিরকাত, লুমায়াত ইত্যাদি)
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো ইরশাদ করেন,
“তোমরা আমার থেকে একটি আয়াত (হাদীস) হলেও তা (মানুষের নিকট) পৌঁছে দাও।”(বুখারী, ফতহুল বারী, ওমাদাতুল ক্বারী, তাইসীরুল ক্বারী, এরশাদুস্ সারী)
অন্য হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, তখন হযরত সাহাবা কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ আরজ করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা নিজেরা পুরোপুরিভাবে আমল করবো, ততক্ষণ পর্যন্ত কি আমরা সৎ কাজের আদেশ দিব না? অথবা যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা সমস্ত খারাবী হতে ক্ষান্ত হবো, ততক্ষণ পর্যন্ত কি অসৎ কাজে নিষেধ করবো না? সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- “না, বরং তোমরা সৎ কাজের আদেশ দান করবে, যদিও তোমরা নিজেরা পুরোপুরিভাবে আমল করতে না পার। তদ্রুপ মন্দ কাজে নিষেধ করবে, যদিও তোমরা নিজেরা পুরোপুরিভাবে বেঁচে থাকতে না পার।” (তিবরানী শরীফ)
সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, “দ্বীন হচ্ছে নছীহত স্বরূপ।”
হযরত সাহাবা কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ জিজ্ঞাসা করলেন, কাদের জন্য? হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “আল্লাহ পাকের জন্য এবং আল্লাহ পাকের প্রিয় রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্য এবং মুসলমানের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের জন্য এবং সাধারণ মুসলমাদের জন্য।” (মুসলিম শরীফ, শরহে নববী, ফতহুল মুলহিম)
উপরোক্ত আয়াত শরীফ ও হাদীস শরীফসমূহ মুবাল্লিগে আম ও মুবাল্লিগে খাছ উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। অর্থাৎ এর হুকুম কারো জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। কাজেই যারা মুবাল্লিগে আম, তারা তাদের দায়িত্ব ও ক্ষেত্র অনুযায়ী উপরোক্ত হাদীস শরীফের আমল করবেন। আর যারা মুবাল্লিগে খাছ, তারাও তাদের দায়িত্ব ও যোগ্যতা এবং ক্ষেত্র অনুযায়ী উপরোক্ত হাদীস শরীফের উপর আমল করবেন।
অতএব প্রত্যেক মুবাল্লিগে আম-এর জন্য তার ক্ষেত্র হচ্ছে- তার অধীনস্থগণ। যাদেরকে তার তরফ থেকে দ্বীনের জন্য তা’লীম দেয়া ও তাকীদ করা দায়িত্ব ও কর্তব্য। অর্থাৎ এটা হচ্ছে তাবলীগে খাছ, যা করা- মুবাল্লিগে আম-এর জন্য ফরজে আইনের অন্তর্ভূক্ত। (তাফসীরে মায্হারী, রুহুল বয়ান, ফতহুল ক্বাদীর, খাযিন, বাগবী, কুরতুবী, ইবনে কাছীর, কবীর)
মুবাল্লিগে খাছ ও তার হিদায়েতের ক্ষেত্রঃ মুবাল্লিগে খাছ বা বিশেষ দ্বীন প্রচারক, মুবাল্লিগে আম-এর মত নয় অর্থাৎ তিনি কেবল তার অধীনস্থদেরই নয় বরং তিনি আমভাবে সকল উম্মতকেই হিদায়েত করার উপযুক্ত। পক্ষান্তরে মুবাল্লিগে আম কেবল তার অধীনস্থদেরই বলার যোগ্যতা রাখে।
আর যারা মুবাল্লিগে খাছ বা বিশেষ দ্বীন প্রচারক, তাঁদের সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেন,
“তোমাদের মধ্যে এমন একটি সম্প্রদায় হওয়া জরুরী, যারা (মানুষকে) কল্যাণ-এর (কুরআন-সুন্নাহ তথা ইসলামের) দিকে ডাকবে এবং সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করবে, আর তারাই মূলতঃ কামিয়াব।” (সূরা আল ইমরান ১০৪)
অর্থাৎ তাঁকে অবশ্যই দ্বীনি বিষয়ে বিশেষ যোগ্যতার অধিকারী হতে হবে এবং ইল্মে ফিক্বাহ ও ইল্মে তাসাউফে বিশেষ দক্ষতা তথা ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নত পরিমাণ ইল্ম, আমল এবং ইখ্লাছ হাছিল করতে হবে।
এ সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেন,
“কেন তাদের প্রত্যেক ক্বওম বা ফিরক্বা থেকে একটি দল বের হয়না এজন্য যে, তারা দ্বীনি ইল্মে দক্ষতা অর্জন করবে এবং তাদের ক্বওমকে ভয় প্রদর্শন করবে, যখন তারা তাদের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে। আশা করা যায়, তারা বাঁচতে পারবে।” (সূরা তওবা ১২২)
আর আল্লাহ পাকের রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
“তোমরা দ্বীনি ইল্ম শিক্ষা কর এবং মানুষকে তা শিক্ষা দাও।” (দারেমী, দারে কুত্নী, মিশকাত, মিরকাত, শরহুত ত্বীবী, তালীকুছছাবী, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত ইত্যাদি)
মূলতঃ যাঁরা মুবাল্লিগে খাছ, তাঁদেরকে অবশ্যই উলামায়ে হক্কানী-রব্বানী হতে হবে। আর হক্কানী-রব্বানী আলিমগণের প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক কুরআন শরীফে ইরশাদ করেন,
“নিশ্চয়ই বান্দাদের মধ্যে আলিমগণই আল্লাহ পাককে ভয় করেন।” (সূরা ফাতির ২৮)
এ আয়াত শরীফের তাফসীর হযরত ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহিকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “যার মধ্যে যতবেশী আল্লাহ ভীতি রয়েছে, তিনি তত বড় আলিম।”
আর হাদীস শরীফে রয়েছে,
“(জিজ্ঞাসা করা হলো) আলিম কে? উত্তরে বললেন, যাঁরা ইল্ম অনুযায়ী আমল করেন। পুণরায় জিজ্ঞাসা করলেন, কোন্ জিনিস আলিমের অন্তর থেকে ইল্মকে বের করে দেয়? তিনি বললেন, লোভ (দুনিয়ার সম্পদ, সম্মান ইতায়দি হাছিলের আকাঙ্কা)।” (দারেমী, মিশকাত, মিরকাত, মুজাহিরে হক্ব, শরহুত ত্বীবী, তালীক, আশয়াতুল লুময়াত ইত্যাদি)
অর্থাৎ যিনি ইল্ম অনুযায়ী আমল করেন, তিনিই হক্কানী-রব্বানী আলিম। কাজেই যিনি ইল্ম, আমল ও ইখলাছ হাছিল করেছেন, তিনিই হক্কানী আলিম, আর তিনিই নবী আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের ওয়ারিছ। যাঁদের শানে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
“আলিমগণ হলেন- আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের ওয়ারিছ বা উত্তরাধিকারী।”(আহমদ, তিরমিযী, আবূ দাঊদ, ইবনে মাযাহ, মিশকাত, মিরকাত, শরহুত্ ত্বীবী, বজলুল মাজহুদ, উরফুশ্ শাজী, তালীক)
অর্থাৎ আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের দাওয়াত ও তাবলীগ, তা’লীম ও তালক্বীন এবং হিদায়েতের ক্ষেত্র যেমন আম বা ব্যাপকভাবে উম্মদের প্রতি প্রযোজ্য, তদ্রুপ যাঁরা মুবাল্লিগে খাছ, তাঁরা আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের ওয়ারিছ হওয়ার কারণে তাঁদেরও দাওয়াত ও তাবলীগ, তা’লীম ও তালক্বীন এবং হিদায়েতের ক্ষেত্র আম বা ব্যাপকভাবে উম্মদের প্রতি প্রযোজ্য। আর এ আম তা’লীম ফরজে কিফায়ার অন্তর্ভূক্ত। যা অতীতে ও বর্তমানে উলামায়ে হক্কানী-রব্বানীগণ তাছাউফ শিক্ষা দিয়ে, মাদ্রাসায় পড়িয়ে, মসজিদে ইমামতি করে, কিতাবাদী লিখে, ওয়াজ-নছীহত করে ইত্যাদি নানানভাবে দাওয়াত ও তা’লীম-তালক্বীন দিয়ে হিদায়েতের কাজ করে মুবাল্লিগে খাছ-এর দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে, তাবলীগে আম-এর (ফরজে কিফায়ার) ও তাবলীগের খাছ-এর (ফরজে আইনের) খেদমতের আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।
মুবাল্লিগে আম-এর জন্য তাবলীগে আম করার হুকুম এবং মুবাল্লিগে খাছ-এর যোগ্যতা ও তাবলীগে আম-এর শর্তঃ
স্মরণীয় যে, যারা মুবাল্লিগে আম অর্থাৎ যাদের জন্য তাবলীগে খাছ করা ফরজে আইনে, তাদের জন্য কোনক্রমেই এবং কষ্মিনকালেও তাবলীগে আম বা ব্যাপকভাবে দ্বীন প্রচার করা (যা মুবাল্লিগে খাছ তথা উলামায়ে হক্কানী-রব্বানীগণের জন্য নির্দিষ্ট তা) জায়েজ নেই।
এ প্রসঙ্গে হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত রয়েছে যে, একদিন এক লোক তাঁর সাক্ষাতে আসলে তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি কর?” সে জাওয়াব দিল, দ্বীন প্রচার করি। তখন তিনি তাকে বললেন, “তুমি কি ঐ সকল আয়াত শরীফের আমল করেছ?” যা কুরআন শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে-
(১) সূরা ছফ-এর ২য় আয়াত শরীফে আল্লাহ পাক বলেন,
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা করনা, তা কেন বল?”
“তুমি কি এ আয়াত শরীফের আমল করেছ?” সে জাওয়াব দিল, না।
(২) তিনি আবার বললেন যে, আল্লাহ পাক সূরা বাকারার ৪৪তম আয়াত শরীফে বলেছেন,
“তোমরা কি মানুষকে সৎ কাজের আদেশ কর, আর নিজেদের ব্যাপারে ভূলে যাও? অথচ তোমরা কিতাব তিলাওয়াত করে থাক।”
“তুমি কি এ আয়াত শরীফের আমল করেছ?” সে জাওয়াব দিল, না।
(৩) পুণরায় তিনি বললেন, তুমি কি ঐ আয়াত শরীফের আমল করেছ? যা হযরত শুয়াইব আলাইহিস সালাম তাঁর ক্বওমকে বলেছিলেন,
“আমি এটা চাইনা যে, তোমাদেরকে যে কাজ থেকে নিষেধ করি, আমি তার খিলাফ করি। অর্থাৎ আমি যা বলি, তা করি আর যা বলিনা, তা করিনা।” (সূরা হুদ ৮৮)
“তুমি কি এ আয়াত শরীফের আমল করেছ?” সে জাওয়াব দিল, না।
তখন হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাকে বললেন, “তুমি প্রথমে এ আয়াত শরীফসমুহের আমল কর, অতঃপর তুমি দ্বীন প্রচারের কাজে নিজেকে নিয়োজিত কর।”
অর্থাৎ উপরোক্ত আয়াত শরীফের আমল ব্যাতিরেকে তাবলীগে আম করা জায়িজ নেই।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা এই প্রমাণিত হলো যে, তাবলীগে খাছ, মুবাল্লিগে আম ও খাছ উভয়ের জন্যই ফরজে আইন। মুবাল্লিগে আম বা সাধারণ লোকদের জন্য তাবলীগে আম করা কখনোই শুদ্ধ হবে না বরং তাদের জন্য তা করা সম্পূর্ণ নাজায়িজ ও হারাম হবে। আর তাবলীগে আম শুধুমাত্র মুবাল্লিগে খাছ তথা হক্কানী আলিমগণের জন্যই প্রযোজ্য, যা তাঁদের জন্য ফরজে কিফায়ার অন্তর্ভূক্ত।
কেননা এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,
“সকল মু’মিনদের জন্য একসাথে কোন কাজে বের হওয়া উচিৎ নয়।” (সূরা তওবা ১২২)
ইমাম-মুজতাহিদ তথা আউলিয়া কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ এই আয়াত শরীফ থেকে উছূল বের করেছেন যে, মু’মিনদের জন্য সমষ্টিগতভাবে কোন কাজ করা ফরজে আইন নয় বরং তা ফরজে কিফায়ার অন্তর্ভূক্ত। (তাফসীরে মায্হারী, রুহুল মা’য়ানী, রুহুল বয়ান, ফতহুল ক্বাদীর, আশশাফ, হাশিয়ারে সাবী, যাদুল মাসীর, খাযিন, বাগবী, কুরতুবী, কবীর, ইবনে কাছীর ইত্যাদি)
অর্থাৎ মুসলামানদের জন্য যেসব কাজ সমষ্টিগতভাবে করতে হয়, সেটা ফরজে কিফায়ার অন্তর্ভূক্ত। তা কখনো ফরজে আইন নয়, যা উপরোক্ত আয়াত শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে।
অতএব, যদি কেউ বলে- মূর্খ হোক, আলিম হোক, ধনী হোক, দরিদ্র হোক, সকল পেশার সকল মুসলমানের জন্য তাবলীগ করা ফরজে আইন। তবে তা সম্পূর্ণই কুরআন-সুন্নাহ ও ইজমা-ক্বিয়াসের খিলাফ বা পরিপন্থী হবে। আর ফরজে কিফায়াকে ফরজে আইন বলাও হারাম ও কুফরীর নামান্তর, যা থেকে বেঁচে থাকা প্রত্যেক মুসলমানের জন্যই ওয়াজিব।
প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের ভ্রান্ত আক্বীদা ও তার খন্ডন (২)
মাওলানা ইলিয়াছ সাহেবের ‘মালফুজাত’সহ আরো কিছু কিতাবে লিখিত আছে যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত অনন্য ধর্মীয় ত্বরীকা, যা সকল দ্বীনি আন্দোলনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত, যার থেকে ভাল ত্বরীকা আর হতে পারেনা।
(হযরতজীর মালফুজাত-২৯, পৃষ্ঠা-২২; তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরু দায়িত্ব, পৃষ্ঠা-৮৫; দাওয়াতে তাবলীগ কি এবং কে?, পৃষ্ঠা-৪৯, লেখক- ওবায়দুল হক; তাবলীগ জামায়াতের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৫৬, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-২৯, লেখক- মৌলুবী মুঃ ইব্রাহিম)
———————————————————————————-
তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণই মিথ্যা, বানোয়াট ও বিভ্রান্তিকর, কেননা প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতে যে দ্বীনি তা’লিম দেয়া হয়, তা পরিপূর্ণ দ্বীনি তা’লিম হতে নিতান্তই কম এবং সেটাকেই তারা পরিপূর্ণ ও যথেষ্ট মনে করে থাকে। অথচ দ্বীন ইসলাম ও তার শিক্ষা অত্যন্ত ব্যাপক ও পূর্ণাঙ্গ। যেমন- পরিপূর্ণ দ্বীনি শিক্ষার বিষয় উল্লেখপূর্বক আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,
“মু’মিনদের প্রতি আল্লাহ পাক-এর ইহ্সান, তাদের মধ্য থেকে তাদের জন্য একজন রসূল প্রেরণ করেছেন, তিনি কিতাব শিক্ষা দিবেন, হিকমত শিক্ষা দিবেন ও তাদেরকে তাযকিয়া (পরিশুদ্ধ) করবেন। যদিও তারা পূর্বে হিদায়েতপ্রাপ্ত ছিলনা।” (সূরা আল ইমরান ১৬৪)
এ আয়াত শরীফে, আয়াত শরীফ তিলাওয়াত করে শুনানো, কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে ইল্মে জাহির বা ইল্মে ফিক্বাহ-এর অন্তর্ভূক্ত, যা দ্বীনের যাবতীয় হুকুম-আহ্কাম পালন করার জন্য ও দৈনন্দিন জীবন-যাপনের জন্য প্রয়োজন। আর (তাযকিয়া) পরিশুদ্ধ ও সংশোধন করার দ্বারা ইল্মে বাতিন বা ইল্মে তাছাউফ উদ্দেশ্য, যার মাধ্যমে মানুষের ক্বাল্ব বা আভ্যন্তরীণ দিক শুদ্ধ হয়। অনূরূপ সূরা বাক্বারা-এর ২৯ ও ১৫১তম আয়াত শরীফে এবং সূরা জুমুয়া-এর ২য় আয়াত শরীফে উপরোক্ত আয়াত শরীফের সমার্থবোধক আরো ৩খানা আয়াত শরীফ উল্লেখ আছে। (তাফসীরে মায্হারী, রুহুল বয়ান, ফতহুল ক্বাদীর, খাযিন, বাগবী, কুরতুবী, ইবনে কাছীর, কবীর, দুররে মানছূর, আবী সউদ, রুহুল মায়ানী, তাবারী, মায়ারিফুল কুরআন ইত্যাদি)
মূলতঃ এ ক্বাল্ব বা অন্তর পরিশুদ্ধ করার শিক্ষাই হচ্ছে মূল শিক্ষা। কেননা ক্বাল্ব শুদ্ধ না হলে মানুষের কোন ইবাদত-বন্দেগী, ধন-সম্পদ, প্রতিপত্তি আল্লাহ পাক-এর নিকট কবুলযোগ্য হয় না। ফলে সে পরকালে কোন ফায়দা বা উপকারও হাছিল করতে পারবেনা।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক বলেন,
“ক্বিয়ামতের দিন কেউ তার ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দ্বারা ফায়দা বা উপকার হাছিল করতে পারবেনা। একমাত্র ঐ ব্যক্তি ব্যতীত, যে প্রশান্ত বা পরিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে উপস্থিত হবে।” (সূরা শুয়ারা ৮৮-৮৯)
আর অন্তর বা ক্বাল্ব প্রশান্ত ও পরিশুদ্ধ হয় একমাত্র আল্লাহ পাক-এর যিকিরের মাধ্যমে। আল্লাহ পাক বলেন,
“সাবধান! আল্লাহ পাক-এর যিকিরের দ্বারাই অন্তর প্রশান্তি লাভ করে।” (সূরা র’দ ২৮)
হাদীস শরীফে বর্ণিত রয়েছে,
“নিশ্চয়ই (মানুষের) শরীরে এক টুকরা গোশ্ত রয়েছে। সেটা যদি পরিশুদ্ধ হয়, তবে গোটা শরীরই পরিশুদ্ধ হয়ে যায়। আর সেটা যদি বরবাদ হয়ে যায়, তবে গোটা শরীরই বরবাদ হয়ে যায়। সাবধান! সেই টুকরা গোশ্তের টুকরাটির নাম হচ্ছে ক্বাল্ব বা অন্তর।” (বুখারী শরীফ)
অর্থাৎ ক্বাল্ব শুদ্ধ হলে মানুষের ঈমান-আক্বীদা, আমল-আখলাক্ব, সীরত-ছূরত সবকিছু শুদ্ধ হয়ে যায়। আর ক্বাল্ব অশুদ্ধ বা বরবাদ হলে সবকিছুই বরবাদ হয়ে যায়। মূলতঃ তখন বান্দার কোন কিছুই আল্লাহ পাক কবুল করেন না।
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, অনন্য, শ্রেষ্ঠ, সম্মানিত ও কামিয়াব তারাই, যাঁরা ইল্মে ফিক্বাহ-এর সাথে সাথে ইল্মে তাছাউফ চর্চা করার মাধ্যমে নিজেদের ক্বাল্ব বা অন্তর ইছ্লাহ্ বা পরিশুদ্ধ করেছেন।
তাহলে ক্বাল্ব শুদ্ধকরণ ইল্ম বা ইল্মে তাছাউফ ব্যতীত শুধুমাত্র যৎসামান্য ইল্মে ফিক্বাহ শিক্ষা করে কিভাবে দাবী করতে পারে যে, “প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত অনন্য ধর্মীয় ত্বরীকা, যা সকল দ্বীনি আন্দোলনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত, যার থেকে ভাল ত্বরীকা আর হতে পারেনা।” মূলতঃ তাদের এই দাবী সম্পূর্ণ মিথ্যা, কল্পনা প্রসূত এবং কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজ্মা ও ক্বিয়াসের খিলাফ।
অপর পক্ষে শুদ্ধ ও সঠিক দাবী হলো তাদের, যারা উভয় প্রকার ইল্ম তথা ইল্মে ফিক্বাহ ও ইল্মে তাছাউফ-এর যথার্থ ও পরিপূর্ণ শিক্ষা অর্জনপূর্বক দ্বীনের তা’লীম-তালক্বীন ও তাবলীগের কাজে নিয়োজিত। এ সম্পর্কে হাদীস শরীফে বর্ণিত রয়েছে,
“ইল্ম দু’প্রকার, একটি হচ্ছে- ক্বালবী ইল্ম (ইল্মে তাছাউফ), যা উপকারী ইল্ম। অপরটি হচ্ছে- জবানি ইল্ম (ইল্মে ফিক্বাহ), যা আল্লাহ পাক-এর তরফ থেকে বান্দার প্রতি দলীল স্বরূপ।” (দারেমী, মিশকাত, আশয়াতুল লুময়াত)
এ হাদীস শরীফের ব্যাখ্যায় মালেকী মাযহাবের ইমাম, ইমামুর দাহ্র, ফখরুদ্দীন, শায়খুল মাশায়িখ, রহ্নুমায়ে শরীয়ত ওয়াত্ব তরীক্বত, ইমামুল আইম্মা, হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
“যে ব্যক্তি ইল্মে ফিক্বাহ শিক্ষা করলো, কিন্তু ইল্মে তাছাউফ শিক্ষা করলো না, সে ব্যক্তি ফাসেকের অন্তর্ভূক্ত। আর যে তাছাউফ করে অর্থাৎ মা’রিফাত চর্চা করে অথচ ইল্মে ফিক্বাহ শিক্ষা করে না অর্থাৎ শরীয়ত মানে না বা অস্বীকার করে, সে যিন্দিক বা কাফিরের অন্তর্ভূক্ত। আর যে উভয়টাই শিক্ষা করলো, সেই মুহাক্কিক অর্থাৎ সেই আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের ওয়ারিছ বা হক্কানী আলিম।” (মিরকাত)
সুতরাং প্রচলিত ৬ উছূলভিত্তিক তাবলীগ জামায়াত সম্পূর্ণ তাছাউফ শুন্য হয়ে শুধুমাত্র যৎসামান্য ইল্মে ফিক্বাহ শিক্ষা করে কিভাবে দাবী করতে পারে যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতই শ্রেষ্ঠ, সম্মানিত ও অনন্য ধর্মীয় ত্বরীকা? মূলতঃ তাদের এ দাবী সম্পূর্ণই অবান্তর ও কল্পনা প্রসূত।
প্রকৃতপক্ষে ইল্মে ফিক্বাহ ও ইল্মে তাছাউফ সমন্বিত শিক্ষাই হচ্ছে- অনন্য, শ্রেষ্ঠ ও পরিপূর্ণ শিক্ষা, যা হক্কানী-রব্বানী আলিমগণ শিক্ষা দিয়ে থাকেন। কাজেই একমাত্র হক্কানী-রব্বানী পীরানে তরীক্বত, আউলিয়া-ই-কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিগণের দরবারেই পূর্ণ ইসলাম বা ইসলামী শিক্ষা হাছিল করা সম্ভব।
এ প্রসঙ্গে অবিস্মরণীয় আলিম, মহা দার্শনিক, প্রখ্যাত ইমাম ও পঞ্চম হিজরী শতকের মুজাদ্দিদ, হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি, যাঁর ইল্মের তীব্রতা এত বেশী ছিল যে, সে তেজোচ্ছাটায় সবাই তটস্থ থাকতো। যাঁর সমঝের ব্যাপকতা ও ক্ষুরধার যুক্তি উপস্থাপনার এত দক্ষতা ছিল, যে কারণে সারাজীবনে সকলেই তাঁর কাছে বাহাছে পরাজিত হয়েছে। অপরদিকে যিনি এত অল্প সময়ে তৎকালীন বিশ্ববিখ্যাত ও সমাদৃত বাগদাদের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ পদ অলংকৃত করেছিলেন, তাঁর পূর্বে ও পরে কেউ এত অল্প বয়সে উক্ত পদে অধিষ্ঠিত হতে পারেননি এবং এক কথায় এতসব গুণের অধিকারী হওয়ার উছিলায় যাঁর দ্বারা তৎকালে ইসলাম ছেড়ে প্রায় সর্বোতভাবে গ্রীক দর্শণের দিকে ঝুঁকে পড়া মুসলমানদেরকে যিনি সারগর্ভ হিদায়েতের বাণী শুনিয়ে ইসলামের দিকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়ে “হুজ্জাতুল ইসলাম” (অর্থাৎ ইসলামকে পূনজ্জীবিতকারী) লক্বব বা উপাধী দ্বারা অদ্যাবধি সমগ্র বিশ্বে বিশেষভাবে সম্মানিত। সে মহান পুরুষের ইল্মে তাছাউফের তাৎপর্য উপলব্ধি ও তার গুরুত্ব অনুধাবনের ঘটনাটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য, যা তিনি নিজেই যথার্থভাবে প্রকাশ করেছেন তাঁর প্রখ্যাত “আল মুনকেযু মিনাদ্দালাল” (বাংলায় “ভ্রান্তির অপনোদন”) কিতাবে।
উল্লেখ রয়েছে, তিনি প্রথমে ইল্মে কালাম বা মুতাকাল্লিমদের বিষয়ের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। সে বিষয়ে ব্যাপক পর্যালোচনার দ্বারা তার গুঢ়মর্ম উপলব্ধিতে সক্ষম হন এবং তাকে তিনি অপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেন। অতঃপর তিনি দর্শণের মনযোগী হন এবং অল্প সময়েই (দু’বছরেই) পরিপূর্ণভাবে দর্শণশাস্ত্র আয়ত্ত করেন। আর এরপরেও এক বছর ধরে তিনি অর্জিত জ্ঞানের বিশেষ উপলব্ধি দ্বারা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে দেখতে পান যে, দর্শণের অনেকটাই প্রবঞ্চনাপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর। তাই দর্শণও তাঁকে আশ্বস্ত করলোনা। আর এরপরে তিনি তা’লিমী শিয়া সম্প্রদায়ের বাতেনী মতবাদ নিয়ে গবেষণা করেন। কিন্তু এ সম্প্রদায়ের স্থানে অস্থানে বাতেনী ইমামের বরাত তাঁকে এ সম্প্রদায়ের প্রতি বিতঃশ্রুদ্ধ করে তোলে। এমনিতর অবস্থায় তিনি এক সময় হাজির হন তাঁর ভাই হযরত আহ্মদ গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর এক মাহফিলে এবং সেখানে হযরত আহ্মদ গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি পরিবেশিত একটি কাছীদা শুনে তাঁর ভাবাবেগের সৃষ্টি হয়। কাছীদাটির ভাবার্থ ছিল এরূপ-
“আর কতকাল জাহিরী ইল্মের বড়াই ধরে রাখবে? অন্তরের কলুষতা হিংসা, রিয়া, ফখর থেকে কবে আর মুক্ত হবে?”
অন্তরের অস্থিরতার এ সময়ে তাঁর মানসপটে ভেসে উঠে দু’টি স্মৃতি, যা সংঘটিত হতো বাদশাহর দরবারে। একটি হলো- যখন ইমামুল হারামাইন রহমতুল্লাহি আলাইহি (যিনি বিশ্ববিখ্যাত আলিম এবং তৎকালীন সকল উলামাদের শ্রদ্ধেয় ইমাম ও হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর ওস্তাদ) বাদশাহর দরবারে যেতেন তখনকার স্মৃতি। অপরটি হলো- বাদশাহর দরবারে অপর একজন সূফী ও শায়খ, আবূ আলী ফারমুদী রহমতুল্লাহি আলাইহি (যিনি ছিলেন তৎকালে আল্লাহ পাক-এর লক্ষ্যস্থল) যখন হাজির হতেন তখনকার স্মৃতি। প্রথম ক্ষেত্রে হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি যখন তাঁর ওস্তাদের সাথে বাদশাহর দরবারে তাশ্রীফ রাখতেন, তখন বাহশাহ্ ইমামুল হারামাইন রহমতুল্লাহি আলাইহিকে তা’যীম করে স্বীয় সিংহাসনের পাশে অন্য আসনে বসাতেন। অন্যদিকে যখন শায়খ আবূ আলী ফারমুদী রহমতুল্লাহি আলাইহি বাদশাহর দরবারে তাশ্রীফ রাখতেন, তখন বাহশাহ্ তাঁকে অধিকতর তা’যীম-তাক্রীম করে নিজ সিংহাসনে বসাতেন এবং বাহশাহ্ স্বয়ং নীচে বসতেন।
এ ঘটনার স্মৃতি হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে এবং তাঁকে সূফী সম্প্রদায়ের প্রতি অনুপ্রণিত করে তোলে। সূফীতত্ত্ব বা ইল্মে তাছাউফ-এর দিকে মনযোগ দিয়েই তিনি বুঝতে পারেন যে, পূর্ণাঙ্গ সূফী তরীক্বার মধ্যেই রয়েছে বুদ্ধিবৃত্তির (ইল্মী আক্বীদা) এবং ব্যবহারিক কার্যক্রম (আমল ও রিয়াযত)-এর সমন্বয়। তিনি বলেন, “আমলের চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তির আক্বীদা ও বিশ্বাস আমার কাছে অনেক সহজ মনে হচ্ছে।” তবে তিনি উল্লেখ করেন, “সূফীবাদের যে দিকটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা কেবল পড়াশুনা বা অন্যকিছু দ্বারা সম্ভব নয় বরং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা (জওক বা স্বাদ) তন্ময় সাধনা এবং নৈতিক পরিবর্তনের মাধ্যমেই তা অর্জন করা সম্ভব।” তিনি উদাহরণ পেশ করেন, “স্বাস্থ্য ও স্বস্তির সংজ্ঞা জানা এবং এগুলোর কারণ নির্ধারণ করা, আর স্বাস্থ্য ও স্বস্তি লাভের মধ্যে বড় প্রভেদ।”
তিনি উল্লেখ করেন, “আমি পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারলাম, সূফীগণ কথায় মানুষ নন, তাঁদের প্রকৃত অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং পড়াশুনার মাধ্যমে যতটা অগ্রসর হওয়া সম্ভব তা আমি করেছি। এখন আমার বাকী রয়েছে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বা আস্বাদন এবং তাছাউফ সাধনের পথ প্রত্যক্ষভাবে অতিক্রমের দ্বারাই তা লাভ করা যেতে পারে।”
উল্লেখ্য, এরপরে তাছাউফ শিক্ষার পিছনে বা সূফী হওয়ার বাসনায় তিনি দীর্ঘ ১০ বছর কাটিয়ে দেন এবং ইল্মে তাছাউফ বা সূফীদের সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা লাভ করেন, সে সম্পর্কে বলেন, “আমি নিশ্চতভাবে বুঝতে পেরেছি যে, কেবল সূফীরাই আল্লাহ পাকের পথের পথিক। তাঁদের জীবনই হলো সর্বোত্তম জীবন, তাঁদের তরীক্বাই নিখুঁত তরীক্বা, তাঁদের চরিত্রই সুন্দরতম চরিত্র। বুদ্ধিজীবিদের সকল বুদ্ধি, জ্ঞানীদের সকল জ্ঞান এবং পন্ডিতদের সকল পান্ডিত্য, যাঁরা খোদায়ী সত্যের প্রগাঢ়তা সম্পর্কে দক্ষ, তাদের সকলের জ্ঞান-বুদ্ধি একত্র করলেও তা দিয়ে সূফীদের জীবন এবং চরিত্র উন্নততর করা যাবেনা বা সম্ভব নয়। সূফীদের অন্তরের বা বাইরের সকল গতি এবং স্থৈর্য নুবুওওয়াতের নূরের জ্যোতি দ্বারা উদ্ভাসিত, নুবুওওয়াতের জ্যোতি ছাড়া ধরার বুকে অন্য কোন আলো নেই, যা থেকে জ্যোতির ধারা পাওয়া যেতে পারে।”
তিনি লিখেন, “সূফী তরীক্বার প্রথম স্তর থেকেই শুরু হয় ইলহাম ও দীদার (দর্শন)। সূফীগণ এ সময়ে জাগ্রত অবস্থায় ফিরিস্তা এবং আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের রূহ মুবারকের দর্শন লাভ করেন। শুনতে পান তাঁদের বাণী এবং নির্দেশ। অতঃপর তাঁরা আরো উচ্চস্তরে উপনীত হন। আকার ও প্রতীকের উর্দ্ধে এমন এক পরিমন্ডলে তাঁরা পৌঁছে যান, ভাষায় যার বর্ণনা দান সম্ভব নয়।”
তিনি লিখেন, “যারা সূফীদের মাহ্ফিলে বসে, তারা তাঁদের নিকট থেকে বিশেষ ধরণের রূহানিয়াত হাছিল করে।”
তিনি সূফীদের এই বিশেষ মর্তবা সম্পর্কে কুরআন শরীফের আয়াত শরীফ পেশ করেন,
“তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে ইল্ম (ইল্মে তাছাউফ) দেয়া হয়েছে, আল্লাহ পাক তাদের সম্মান ও মর্যাদাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিবেন।” (সূরা মুজাদালাহ ১১)
আর যারা সূফীদের বিরোধিতা করে অথবা তা থেকে গাফিল থাকে, তাদেরকে তিনি নেহায়েত অজ্ঞ বলে মন্তব্য করেন এবং তাদের প্রতি কুরআন শরীফের এই আয়াত শরীফ প্রযোজ্য বলে মন্তব্য করেন,
“তাদের মধ্যে কেউ কেউ আপনার কথা শুনতে আসে, অতঃপর আপনার নিকট থেকে বের হবার পর যারা জ্ঞান লাভে সমর্থ হয়েছে তাদের জিজ্ঞেস করে এই ব্যক্তি এখন কি বললো? ওরা ঐসব লোক, যাদের হৃদয়ে আল্লাহ তায়ালা সীলমোহর মেরে দিয়েছেন। এরা তাদের প্রবৃত্তির দাসত্ব করে যাচ্ছে। অর্থাৎ তারা মুক, বধির এবং অন্ধ হয়ে গেছে।” (সূরা মুহম্মদ ১৬)
হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি এই মন্তব্য করেন যে, “দ্বীনের সকল পথের পথিকদের মধ্যে একমাত্র সূফীরাই পরিপূর্ণ।” তিনি উদাহরণ দেন, “জাহিরী ইল্ম হলো খোসা মাত্র। আর সূফীতত্ত্ব অথবা ইল্মে তাছাউফ হলো তার অভ্যন্তরীস্থিত শাঁস বা মূল বস্তুর ন্যায়।” তাই তিনি আরো মন্তব্য করেন যে, “যদি কিছু থেকে থাকে, তবে সূফীগণের কাছেই তা রয়েছে।”
উল্লেখ্য, তাই তিনি সূফীগণের সোহ্বত ইখতিয়ার করা তাঁদের কাছে বাইয়াত হওয়া ফরজের অন্তর্ভূক্ত বলে তাঁর রচিত ‘কিমিয়ায়ে সায়াদাত’ কিতাবে উল্লেখ করেছেন এবং তিনি নিজেও হযরত আবূ আলী ফারমুদী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর নিকট বাইয়াত হয়ে তাক্মীলে (পূর্ণতায়) পৌঁছেন।
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, ইল্মে তাছাউফ-এর পথই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত পথ এবং এর মধ্যেই পূর্ণতা রয়েছে। আর প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের মাধ্যমে কস্মিনকালেও ইসলামের পূর্ণ শিক্ষা হাছিল করে তাক্মীলে পৌঁছা সম্ভব নয়। ইসলামে পরিপূর্ণভাবে দাখিল হওয়া প্রসঙ্গে কুরআন শরীফে আল্লাহ পাক বলেন,
“হে ঈমানদাগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে দাখিল হও।” (সূরা বাক্বারা ২০৮)
তাহলে যারা প্রচলিত তাবলীগ করবে, তাদের পক্ষে কি করে সম্ভব পরিপূর্ণভাবে ইসলামে দাখিল হওয়া বা পরিপূর্ণভাবে ইসলামকে অনুসরণ করা? আর এ প্রচলিত তাবলীগই কিভাবে সবচেয়ে উত্তম, শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত আন্দোলন এবং একমাত্র পথ হতে পারে?
সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের এই বক্তব্য সম্পূর্ণই মনগড়া, বানোয়াট এবং কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজ্মা ও ক্বিয়াসের খিলাফ। আর যেহেতু প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের মাধ্যমে ইসলামের পরিপূর্ণ শিক্ষা অর্জন করা কখনোই সম্ভব নয়। সেহেতু প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত কখনোই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আন্দোলন বা উত্তম ত্বরীকা হতে পারে না।
প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের ভ্রান্ত আক্বীদা ও তার খন্ডন (৩)
প্রচলিত ৬ উছূলভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতের লোকদের লিখিত কিতাবে এ কথা উল্লেখ আছে যে, প্রচলিত তাবলীগ হচ্ছে নবীওয়ালা কাজ।
(তাবলীগ জামায়াত প্রসঙ্গে ১৩ দফা, পৃষ্ঠা-১৪, লেখক- মুহম্মদ মুযাম্মিলুল হক)
————————————————————————————
প্রচলিত ৬ উছূলভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতের লোকদের তাদের প্রচলিত তাবলীগকে যে জন্য নবীওয়ালা কাজ বলতে চায়, সেটা হলো- তারা মনে করে যে, নবী আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণ যেভাবে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন, তারাও বুঝি সেভাবেই ইসলামের দাওয়াত দেয়। কিন্তু হাক্বীক্বতে এ দু’য়ের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক। কারণ নবী আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণ সকলেই মা’রিফাতে পূর্ণ হয়ে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন এবং তা দেয়া হয়েছে কাফিরদেরকে। সে কারণে বলা হয় যে, সকল নবী আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের তাছাউফ এক, কিন্তু শরীয়ত আলাদা। কিন্তু প্রচলিত ৬ উছূলভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতের প্রায় সবাই একেবারেই তাছাউফ শুণ্য হয়ে তাদের ৬ উছূলভিত্তিক দাওয়াত দেয়। যে দাওয়াতটা মূখ্যতঃ মুসলমানদেরকে দেয়া হয়।
কাজেই প্রচলিত ৬ উছূলভিত্তিক তাবলীগ জামায়াত যা করে, তা মুসলমানদেরকে সাধারণ তা’লীম-তালক্বীন দেয়া ব্যতীত কিছুই নয়।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে আরো কথা এসে যায়, সেটা হচ্ছে এই যে, মাদ্রাসা-মক্তবে কিতাবী দর্স ও তা’লীম দেয়া, মসজিদে, জনসমাবেশে ওয়াজ-নছীহত করা, দ্বীনি ইল্মের জন্য কিতাব প্রনয়ণ করা সর্বোপরি, পীরানে তরীক্বত, আউলিয়া-ই-কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ তাঁদের খান্কা শরীফে ও দরগায় এই ইল্মে তাছাউফ ও ইল্মে ফিক্বাহ শিক্ষা দেয়া কি তাহলে নবীওয়ালা কাজ নয়? তবে কি এটি শয়তানওয়ালা কাজ? (নাঊযুবিল্লাহ্ মিন যালিক) কোন ব্যক্তি যদি এরূপ আক্বীদা পোষণ করে, তাহলে সে ঈমান হারা হয়ে কুফরীতে নিপতিত হবে।
উল্লেখ্য, যদিও প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা সুরতান নবীওয়ালা কাজ বলে দাবী করে, কিন্তু হাক্বীক্বতান তারা নবীওয়ালা কাজ করেনা। কারণ সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“নিশ্চয়ই আলিমগণ নবী আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের ওয়ারিছ এবং নিশ্চয়ই নবী আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের কোন দিনার-দিরহাম রেখে যাননি বরং তাঁরা ইল্মে দ্বীন রেখে গিয়েছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করলো, সে পূর্ণ অংশ (বিরাট সফলতা) লাভ করলো।” (আহ্মদ, তিরমিযী)
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন,
“ইল্ম দু’প্রকার, একটি হচ্ছে- ক্বালবী ইল্ম (ইল্মে তাছাউফ), যা উপকারী ইল্ম। অপরটি হচ্ছে- জবানি ইল্ম (ইল্মে ফিক্বাহ), যা আল্লাহ পাক-এর তরফ থেকে বান্দার প্রতি দলীল স্বরূপ।” (দারেমী, মিশকাত, মিরকাত, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত)
মিশকাত শরীফের শারেহ, হযরত মুল্লা আলী ক্বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর মিরকাত শরীফে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন, মালেকী মাযহাবের ইমাম, হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
“যে ব্যক্তি ইল্মে ফিক্বাহ শিক্ষা করলো, কিন্তু ইল্মে তাছাউফ শিক্ষা করলো না, সে ব্যক্তি ফাসেকের অন্তর্ভূক্ত। আর যে তাছাউফ করে অর্থাৎ মা’রিফাত চর্চা করে অথচ ইল্মে ফিক্বাহ শিক্ষা করে না অর্থাৎ শরীয়ত মানে না বা অস্বীকার করে, সে যিন্দিক বা কাফিরের অন্তর্ভূক্ত। আর যে উভয়টাই শিক্ষা করলো, সেই মুহাক্কিক অর্থাৎ সেই নবী আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের ওয়ারিছ বা হক্কানী আলিম।”
উল্লেখ্য যে, যিনি ইল্মে ফিক্বাহ ও ইল্মে তাছাউফ হাছিল করেছেন, তিনিই হচ্ছেন নবী আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের ওয়ারিছ বা নায়েবে নবী। যাঁরা নবী আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের ওয়ারিছ বা নায়েবে নবী, তাঁদের পক্ষেই একমাত্র নবীওয়ালা কাজ পূর্ণভাবে করা সম্ভব। অথচ প্রচলিত ৬ উছূলভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতের উছূলের মধ্যে তাছাউফ-এর কোন শিক্ষাই নেই, শুধুমাত্র ইল্মে ফিক্বাহ্র শিক্ষা যৎসামান্যই রয়েছে। তাহলে কি করে প্রচলিত ৬ উছূলভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতের লোকদের পক্ষে হাক্বীক্বতান নবীওয়ালা কাজ করে দাবী করা সম্ভব?
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, তাদের এই বক্তব্য মনগড়া, বানোয়াট ও বিভ্রান্তিকর, যার থেকে বেঁচে থাকা সকলের জন্যই দায়িত্ব ও কর্তব্য।
প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের ভ্রান্ত আক্বীদা ও তার খন্ডন (৪)
প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস সাহেবের মাল্ফুযাতের ৫৩তম পৃষ্ঠার ৮০তম মালফুযে একথা উল্লেখ আছে যে, প্রচলিত তাবলীগের বা অতরীক্বত পন্থীদের, তাছাউফ-এর বা সূফীদের বই পড়া উচিৎ নয়।
————————————————————————————
বস্তুত তাছাউফ-এর বা সূফীদের কিতাবে তাছাউফ সম্পর্কে যে সূক্ষ্ম বর্ণনা রয়েছে, তা প্রচলিত তাবলীগওয়ালা বা অতরীক্বত পন্থীদের পক্ষে বোঝা সত্যিই খুব দুরূহ ব্যাপার। সেজন্য তাদেরকে ইল্মে তাছাউফ থেকে ফিরিয়ে রাখা কখনই জায়িয হবে না। কারণ প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য জরুরত আন্দাজ ইল্মে তাছাউফ শিক্ষা করা ফরজ।
কাজেই “অতরীক্বত পন্থীদের, তাছাউফ-এর বা সূফীদের বই পড়া উচিৎ নয়” একথা বলার অর্থ হলো- পূর্ণ ইসলামী শিক্ষা থেকে মাহ্রুম করা ও অন্তর পরিশুদ্ধ করে ইখলাছ অর্জনে বাধা সৃষ্টি করা, যা সম্পূর্ণই শরীয়ত বিরোধী। কারণ কোন লোক যখন ইল্মে তাছাউফ অর্জন বা ক্বালবী যিকির থেকে বিরত থাকে, তখন শয়তান তার সঙ্গী হয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক কুরআন শরীফে ইরশাদ করেন,
“যে ব্যক্তি আমার যিকির থেকে বিরত থাকে, তার জন্য একটি শয়তান নির্দিষ্ট হয়ে যায়, সে তাকে ওয়াস্ওয়াসা দিয়ে গোমরাহ্ করে দেয়।” (সূরা যুখরূফ ৩৬)
আর হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে,
“শয়তান মানুষের অন্তরে বসে, যখন সে যিকির করে, তখন পালিয়ে যায়। আর যখন যিকির থেকে গাফিল থাকে, তখন ওয়াস্ওয়াসা দেয়।” (বুখারী শরীফ)
কাজেই প্রমাণিত হলো যে, ইল্মে তাছাউফ চর্চা থেকে বিরত রাখার অর্থ হলো- লোকদেরকে শয়তানের সঙ্গী করে দেয়া বা গোমরাহিতে নিপতিত করা। আরো উল্লেখ্য যে, সূফীদের বই পড়া বা ইল্মে তাছাউফ থেকে বিরত রাখার অর্থ হচ্ছে, দ্বীন ইসলামের অর্ধ শিক্ষা ও অর্ধ আমল থেকে বিরত রাখা। অথচ আল্লাহ পাক পরিপূর্ণভাবে দ্বীন ইসলামের মধ্যে দাখিল হতে বলেছেন।
এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে,
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণরূপে দ্বীন ইসলামে দাখিল হও।” (সূরা বাক্বারা ২০৮)
অন্যত্র আল্লাহ পাক বলেন,
“আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম।” (সূরা মায়িদা ৩)
প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত বক্তব্য আল্লাহ পাক-এর বিধানের বিপরীত, যা দ্বীনের মধ্যে তাহ্রীফের শামিল ও কুফরীর অন্তর্ভূক্ত। তারা কি চায়, এই কথা বলে ইল্মে তাছাউফকে নিশ্চিহ্ন করতে বা ইল্মে তাছাউফ-এর শিক্ষা থেকে সাধারণ লোকদেরকে দূরে রেখে নিজেদের দল ভারী করতে। মূলতঃ এটা কস্মিনকালেও সম্ভব নয়।
কারণ আল্লাহ পাক পবিত্র কালামে ইরশাদ করেন,
“তারা চায়, আল্লাহ পাক-এর নূরকে ফু দিয়ে নিভিয়ে দিতে। আল্লাহ পাক তাঁর নূরকে পরিপূর্ণ করবেন, যদিও কাফিরেরা তা পছন্দ করেনা।” (সূরা ছফ ৮)
উপরোক্ত আয়াত শরীফে নূর-এর ব্যাখ্যায় মুহাক্কিক-মুদাক্কিক ও অনুসরণীয় মুফাস্সিরীন-ই-কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ বলেন, নূর হচ্ছে-দ্বীন ইসলাম। আর ইসলাম হচ্ছে- ইল্মে ফিক্বাহ্ ও ইল্মে তাছাউফ-এর সমন্বয়। (তাফসীরে মায্হারী, ইবনে কাছীর, রুহুল মায়ানী, রুহুল বয়ান, কবীর, ফত্হুল ক্বাদীর, তাবারী, আবী সউদ ইত্যাদি)
অতএব, ইল্মে তাছাউফ থেকে ফিরিয়ে রাখা অর্ধ দ্বীন থেকে ফিরিয়ে রাখার নামান্তর, যা কুফরীর শামিল। তাই ইল্মে তাছাউফ, যা দ্বীন ইসলাম পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করার মূল ও একমাত্র মাধ্যম, তা কারো পক্ষেই নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব নয়, বরং তা ক্বিয়ামত পর্যন্তই বহাল থাকবে।
সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের উপরোক্ত বক্তব্য সম্পুর্ণই শরীয়ত বিরোধী। কাজেই এই কথা বলা তাদের উচিৎ হয়নি, বরং তাদের উচিৎ হবে এই কথা বলা যে, যারা প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোক বা অতরীক্বতপন্থী, তারা যেন হক্কানী পীরানে তরীক্বত, আউলিয়া-ই-কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের কাছে বাইয়াত হয়ে তাছাউফ শিক্ষা ও কিতাবাদী পাঠের মাধ্যমে ফরজ পরিমাণ ইল্ম অর্জন করে। (দুররুল মুখতার, শামী, তাফসীরে মায্হারী, কবীর, রুহুল মায়ানী, মাকতুবাত শরীফ, ইহইয়াউ উলুমিদ্দীন, কিমিয়ায়ে সায়াদাত, ফত্হুর রব্বানী, আল বুনিয়ানুল মুশাইয়্যাদ ইত্যাদি)
প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের ভ্রান্ত আক্বীদা ও তার খন্ডন (৫)
প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের অনেকেই বলে থাকে যে, প্রচলিত ৬ উছূলী তাবলীগে অংশগ্রহণ না করলে ও চিল্লা না দিলে ঈমান ও এক্বীন সহীহ্ হয়না। তাই সাধারণ লোক ইছলাহ্প্রাপ্ত হওয়ার জন্য তিন চিল্লার দরকার। এছাড়াও প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা বলে থাকে যে, মূর্খ লোক চিল্লা দিলে আলিমের চেয়ে বেশী ফযীলত প্রাপ্ত হয়, আর মূর্খ লোক ইছলাহ্প্রাপ্ত হওয়ার জন্য তিন চিল্লা দরকার এবং তাবলীগ জামায়াত প্রসঙ্গে মুযাম্মিলুল হক তার “তেরো দফা” নামক কিতাবে ৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছে, “মূর্খ লোক আমীর হওয়ার জন্য তিন চিল্লাহ্ যথেষ্ট, আর আলেমের জন্য প্রয়োজন সাত চিল্লার।”
————————————————————————————–
তাদের এ বক্তব্য বা আক্বীদাটি কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজ্মা ও ক্বিয়াসের সম্পূর্ণ খিলাফ এবং সমাজে ফিৎনা সৃষ্টির কারণ।
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, “হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, শেষ যামানায় এমন অনেক মিথ্যাবাদী দাজ্জাল বের হবে, যারা এমন সব হাদীসসমূহ বয়ান করবে (মতবাদ বা কথা ছড়াবে), যা তোমরা শুনোনি, তোমাদের বাপ-দাদা কেউ শুনেনি। তোমরা তাদের নিকট গমণ করোনা এবং তাদেরকে তোমাদের নিকট স্থান দিওনা, তাহলে তারা তোমাদেরকে ভ্রান্ত করতে ও ফিৎনায় ফেলতে পারবে না।” (মুসলিম, মিশকাত)
উল্লেখ্য, প্রচলিত তাবলীগ শুরু হয়েছে ১৩৪৫ হিজরীতে আর বর্তমানে ১৪৩০ হিজরী চলছে, অর্থাৎ প্রায় ৮৫ বছর ধরে এই প্রচলিত তাবলীগ চলে আসছে। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, এর পূর্বে যারা ছিলেন অর্থাৎ হযরত সাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ থেকে শুরু করে তাবিয়ীন, তাবি-তাবিয়ীন, ইমাম-মুজতাহিদীন, আউলিয়া-ই-কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ যাঁরাই এসেছেন ১৩৪৫ হিজরীর পূর্ব পর্যন্ত, তাহলে কি তাদের ঈমান ও এক্বীন সহীহ্ বা শুদ্ধ ছিলনা? এরূপ আক্বীদা পোষণ করা কুফরী। যে ব্যক্তি এই আক্বীদা পোষণ করবে, সে ব্যক্তি ঈমান হারা হবে। কেননা এ সমস্ত কথাগুলো কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজ্মা ও ক্বিয়াসের কোথাও নেই। যা সম্পূর্ণই ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও মনগড়া।
আরো উল্লেখ্য যে, আল্লাহ পাক-এর রসূল সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আমার যামানা সর্বোত্তম, অতঃপর পরবর্তী যামানা, অতঃপর তৎপরবর্তী যামানা।” (বুখারী শরীফ)
অথচ উল্লিখিত তিন যামানায় বা খাইরুল কুরুনে প্রচলিত ৬ উছূলভিত্তিক তাবলীগ জামায়াত ও তাদের প্রবর্তিত চিল্লার কোন অস্তিত্বই ছিলনা। এমনকি প্রচলিত ৬ উছূলভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা, ইলিয়াস সাহেবের পীর সাহেব রশীদ আহ্মদ গাঙ্গুহী সাহেবও চিল্লা দেয়নি, তাহলে কি তার ঈমান ও এক্বীন সহীহ্ বা শুদ্ধ ছিলনা?
অথচ ঈমান ও এক্বীন সহীহ্ ও পূর্ণ হওয়ার জন্য আল্লাহ পাক কুরআন শরীফে ইরশাদ করেন,“আপনার রবের কছম! তারা ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে আপনাকে ফায়সালাকারী হিসেবে মেনে না নিবে। অতঃপর আপনার ফায়সালা সম্পর্কে তাদের মনে কোন সংকীর্ণতা থাকবেনা এবং তারা সন্তুষ্টচিত্তে তা গ্রহণ করবে।”(সূরা আন্ নিসা ৬৫)
আর ঈমান পূর্ণ হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহ পাক-এর রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত মু’মিনে কামিল হতে পারবেনা যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা তোমাদের বাবা-মা, সন্তান-সন্ততি, সকল মানুষ থেকে, অর্থাৎ সবকিছু থেকে আমাকে বেশী মুহব্বত না করবে।” (বুখারী, মুসলিম)
হাদীস শরীফে আরো রয়েছে, “যে আল্লাহ পাক-এর জন্য মুহব্বত করে, বিদ্বেষ পোষণ করে, আদেশ করে ও নিষেধ করে, সে ঈমানে পরিপূর্ণ।” (আবূ দাঊদ, তিরমিযী)
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ঈমান ও এক্বীন সহীহ্ বা পূর্ণ হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহ পাক-এর মুহব্বত ও তাঁর রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মুহব্বত ও আনুগত্যতা শর্ত, অন্য কিছু নয়। কাজেই প্রচলিত ৬ উছূলী তাবলীগে অংশগ্রহণ না করলে ও চিল্লা না দিলে ঈমান ও এক্বীন সহীহ্ হবেনা, এটা সম্পূর্ণ ভূল কথা, যা কুফরীর পর্যায়ে পড়ে। বরং অতীতের মুহাক্কিক-মুদাক্কিক, ইমাম-মুজতাহিদ, আউলিয়া-ই-কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ তথা বুযূর্গানে দ্বীনের মতে আল্লাহ পাক-এর মুহব্বত ও তাঁর রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মুহব্বত ও আনুগত্যতা অর্জনের সর্বোত্তম ও অত্যাবশ্যকীয় উপায় হচ্ছে- তাছাউফ শিক্ষা করা। যার কারণে তাঁরা ফতওয়া দিয়েছেন, ইল্মে তাছাউফ শিক্ষা করা ফরজ।
মূর্খ লোক চিল্লা দিলে আলিমের চেয়ে মর্যাদা বেশী, একথা সম্পূর্ণ শরীয়তের খিলাফ, যা কুফরীর শামিল। কারণ আক্বাইদের কিতাবে উল্লেখ আছে, “আলিমগণকে এহানত (তুচ্ছ-তাচ্ছিল্ল্য বা অবজ্ঞা) করা কুফরী।”
আলিমগণের ফযীলত সম্পর্কে কুরআন শরীফে অনেক আয়াত শরীফ এবং অনেক হাদীস শরীফ উল্লেখ করা হয়েছে। আলিমগণের ফযীলত সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেন, “যারা জানে আর যারা জানে না, উভয়ে কি সমান হতে পারে?” (সূরা যুমার ৯)
আল্লাহ পাক আলিমগণের মর্যাদা ও ফযীলত বর্ণনা করতে গিয়ে কুরআন শরীফে ইরশাদ করেন,“যারা আলিম, তাদেরকে অনেক মর্যাদা দেয়া হয়েছে।” (সূরা মুজাদিলা ১১)
আর হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, “আলিমগণ আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের ওয়ারিছ বা উত্তরাধিকারী।” (তিরমিযী, আবূ দাউদ, ইবনে মাযাহ্, দারিমী, আহমদ, মিশকাত, মা’য়ারিফুস্ সুনান, মিরকাত, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, মুজাহিরে হক্ব, উরফুশ্ শাজী, বজলুল মাজহুদ ইত্যাদি)
আলিমগণের মর্যাদা ও ফযীলত সম্পর্কে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, “হযরত আবূ উমামাতুল বাহেলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট দু’জন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম জন আবিদ, আর দ্বিতীয় জন আলিম। (একথা শুনে) সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আলিমের মর্যাদা আবিদের উপর তদ্রুপ, যেমন তোমাদের মধ্যে সাধারণ ব্যক্তির উপর আমার ফযীলত। অতঃপর আরো বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক ও তাঁর ফিরিস্তাগণ এবং আসমান ও যমীনবাসী, এমনকি গর্তের ভিতর পিপীলিকা ও মাছ পর্যন্ত আলিমের প্রতি ছলাত পাঠ করেন।” (তিরমিযী,দারিমী,মিশকাত, মা’য়ারিফুস্ সুনান, মিরকাত, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, মুজাহিরে হক্ব, উরফুশ্ শাজী, তালীক)
আলিমগণের ফযীলত সম্পর্কে হাদীস শরীফে আরো বর্ণিত হয়েছে, “হযরত আবূ দারদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, আমি রসূল পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, নিশ্চয়ই আলিমের জন্য আসমান ও যমীনে যা কিছু রয়েছে, এমনকি পানির মাছ পর্যন্ত ইস্তেগফার (ক্ষমা) প্রার্থনা করে। আর নিশ্চয় আলিমের মর্যাদা আবিদের উপর এরূপ, যেরূপ পূর্ণিমার চাঁদের মর্যাদা অন্যান্য তাকরারাজীর উপর।” (তিরমিযী, আবূ দাউদ, ইবনে মাযাহ্, দারিমী, আহমদ, মিশকাত, মা’য়ারিফুস্ সুনান, মিরকাত, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, মুজাহিরে হক্ব, উরফুশ্ শাজী, বজলুল মাজহুদ)
আলিমগণের মর্যাদা সম্পর্কে হাদীস শরীফে আরো বর্ণিত হয়েছে, “হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, একজন ফক্বীহ্ (হক্কানী আলিম) শয়তানের নিকট এক হাজার আবিদের চেয়েও বেশী ভয়ংকর।” (তিরমিযী, আবূ দাউদ, ইবনে মাযাহ্, দারিমী, আহমদ, মিশকাত, মা’য়ারিফুস্ সুনান, মিরকাত, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, মুজাহিরে হক্ব, উরফুশ্ শাজী)
অতএব, উলামায়ে হক্কানী-রব্বানীগণ আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের পর আল্লাহ পাক-এর যমীনে শ্রেষ্ঠ মানুষ। যার কারণে তাঁদের নিদ্রাকে জাহিল বা মূর্খ ব্যক্তির ইবাদতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, “আলিমের নিদ্রা মূর্খ লোকের ইবাদত হতে উত্তম।”
স্মরনীয় যে, উপরে আলিমদের যে মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে, তা শুধুমাত্র ইল্মে ফিক্বাহ্ ও ইল্মে তাছাউফ অর্জনকারী, ইল্ম অনুযায়ী আমলকারী অর্থাৎ উলামায়ে হক্কানী-রব্বানীগণের জন্যই প্রযোজ্য।
অতএব, আল্লাহ পাক ও তাঁর রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেখানে আলিমদেরকে মূর্খ লোকদের উপর এত ফযীলত দিয়েছেন, সেখানে বিনা দলীল-আদীল্লায় একথা বলা কি করে জায়িয ও শরীয়তসম্মত হতে পারে যে, মূর্খ লোক চিল্লা দিলে আলিমের চেয়ে বেশী ফযীলতপ্রাপ্ত হবে। অথচ প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতে মাত্র মক্তবী শিক্ষা দেয়া হয়। যে মক্তবী শিক্ষার মাধ্যমে কখনো হাক্বীক্বী আলিন হওয়া সম্ভব নয়। আর যেখানে আলিম হওয়াই সম্ভব নয়, সেখানে চিল্লা দিলে কি করে আলিমের চেয়ে বেশী ফযীলতপ্রাপ্ত হবে?
আরো উল্লেখ্য যে, মূর্খ লোক ইছলাহ্ প্রাপ্ত হওয়ার জন্য তিন চিল্লা দিতে হয়, কিন্তু আলিমের ইছলাহ্ প্রাপ্ত হওয়ার জন্য সাত চিল্লা প্রয়োজন। তাদের এ কথাটাও জিহালতপূর্ণ ও কুফরীর অন্তর্ভূক্ত। কারণ একথাও আলিম সম্প্রদায়কে এহানত করার শামিল।
তবে এখানে বিশেষভাবে স্মরনীয় যে, শুধু মাদ্রাসা হতে ফারিগ হলে অর্থাৎ দাওরা বা টাইটেল পাশ করলে মাওলানা হওয়া যায়, হাক্বীক্বী আলিম হওয়া যায় না। কারণ মাদ্রাসায় শুধুমাত্র ইল্মে ফিক্বাহ শিক্ষা দেয়া হয়, ইল্মে তাছাউফ শিক্ষা দেয়া হয় না। অথচ ইল্মে ফিক্বাহের সাথে ইল্মে তাছাউফ অর্জন করাও ফরজে আইন। অতএব, যে ব্যক্তি ইল্মে ফিক্বাহ ও ইল্মে তাছাউফ উভয়টি অর্জন করলো, সে ব্যক্তিই হাক্বীক্বী আলিম বা নায়িবে রসূল। এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “আলিমগণ আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের ওয়ারিছ বা উত্তরাধিকারী। আর নিশ্চয় আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণ কোন দীনার-দিরহাম রেখে যাননি। বরং ইল্ম রেখে গেছেন।” (তিরমিযী, আবূ দাউদ, ইবনে মাযাহ্, দারিমী, আহমদ, মিশকাত, মা’য়ারিফুস্ সুনান, মিরকাত, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, মুজাহিরে হক্ব, উরফুশ্ শাজী, বজলুল মাজহুদ)
অর্থাৎ সে ব্যক্তিই হাক্বীক্বী আলিম বা নায়িবে রসূল। উপরোক্ত হাদীস শরীফ দ্বারা বুঝা গেল যে, আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের ওয়ারিছ স্বত্ত্ব হিসেবে শুধুমাত্র ইল্ম রেখে গেছেন। আর ইল্ম সম্পর্কে হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “ইল্ম দু’প্রকার, একটি হচ্ছে- ক্বালবী ইল্ম (ইল্মে তাছাউফ), যা উপকারী ইল্ম। অপরটি হচ্ছে- জবানি ইল্ম (ইল্মে ফিক্বাহ), যা আল্লাহ পাক-এর তরফ থেকে বান্দার প্রতি দলীল স্বরূপ।” (দারেমী, বায়হাক্বী, দায়লামী, মিশকাত, মিরকাত, মুজাহিরে হক্ব, তারগীব ওয়াত্ব তারহীব, তারীখ, আব্দুল বার, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী)
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের ওয়ারিছ স্বত্ত্ব হিসেবে ইল্মে ফিক্বাহ ও ইল্মে তাছাউফ উভয়টি রেখে গেছেন। যে ব্যক্তি উভয়টাই শিক্ষা করলো, সেই মুহাক্কিক অর্থাৎ সেই আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের ওয়ারিছ বা হক্কানী আলিম।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যারা ইল্মে ফিক্বাহ অর্জন করে মাওলানা হয়েছে, তাদের উচিত হবে, পীরানে তরীক্বত বা আল্লাহ্ওয়ালাগণের সোহবত এখতিয়ার করে, ইল্মে তাছাউফ অর্জন করার মাধ্যমে ইছলাহ্ প্রাপ্ত হয়ে হাক্বীক্বী আলিম বা নায়িবে রসূল হওয়া। তাই আল্লাহ আপাক কালামে পাক-এ ইরশদ করেন, “হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ পাককে ভয় কর এবং সত্যবাদী বা আল্লাহ্ওয়ালাগণের সোহবত এখতিয়ার কর।” (সূরা তওবা ১১৯)
উপরোক্ত আলোচনার দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, যারা ইল্মে তাছাউফ অর্জন করেনি, তারা হাক্বীক্বী আলিম নয়। কারণ তাদের অন্তর ইছলাহ্ প্রাপ্ত নয়। কাজেই তাদের তো ইছলাহ্ প্রাপ্ত হওয়ার জন্য পীরানে তরীক্বত বা আল্লাহ্ওয়ালাগণের নিকট বাইয়াত হয়ে ইল্মে তাছাউফ অর্জন করতে হবেই, সাথে সাথে যারা মূর্খ বা জাহিল, তাদেরকেও আল্লাহ্ওয়ালাগণের নিকট বাইয়াত হয়ে ইল্মে তাছাউফ চর্চা করতে হবে। আর যাঁরা হাক্বীক্বী আলিম, তাঁরা তো অবশ্যই ইছলাহ প্রাপ্ত। স্মরণীয় যে, তিন চিল্লা, সাত চিল্লা, দশ চিল্লা কেন, শত-সহস্র চিল্লা দিলেও কেউ ইছলাহ প্রাপ্ত হবে না। কারণ কুরআন-সুন্নাহ-এর কোথাও চিল্লাকে ইছলাহ প্রাপ্ত হওয়ার জন্য শর্ত করা হয়নি। আর এটাও বলা হয়নি যে, চিল্লা দিলে মানুষ ইছলাহ প্রাপ্ত হবে। বরং শর্ত করা হয়েছে, ইছলাহ প্রাপ্ত হওয়ার জন্য ইল্মে তাছাউফ শিক্ষা করাকে।
মূর্খ লোক তিন চিল্লা দিলে আমীর হতে পারে, আর আলিম আমীর হওয়ার জন্য তিন চিল্লা দরকার। তাদের একথাও আলিম ও ইল্মকে এহানত করার শামিল। কারণ ইতিপূর্বে কুরআন শরীফ –হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, আলিমদের মর্যাদা মূর্খ লোকের উপর অনেক বেশী।
অতএব, যে সমস্ত কথাবার্তা শরীয়তের খিলাফ ও যার কোন শরয়ী দলীল নেই, এ ধরনের কথাবার্তা থেকে বেঁচে থাকা বা বিরত থাকা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ওয়াজিব।
প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের ভ্রান্ত আক্বীদা ও তার খন্ডন (৬)
প্রচলিত ৬ উছূলভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতের লোকদের লিখিত কিতাবে এ কথা উল্লেখ আছে যে, “তাবলীগ তথা দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার কারণেই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মতকে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে, অন্য কোন কারণে নয়।” দলীল স্বরূও তারা সূরা আল ইমরান-এর ১১০তম আয়াত শরীফ পেশ করে থাকে।
(দাওয়াতে তাবলীগ কি ও কেন?, লেখক- মুহম্মদ ওবায়দুল হক, পৃষ্ঠা-১১৬; পস্তী কা ওয়াহেদ এলাজ, পৃষ্ঠা-৯, লেখক- মাওঃ এহ্তেশামুল হাসান কান্দলভী, অনুবাদক- ছাখাওয়াত উল্লাহ, পৃষ্ঠা-৯; তাবলীগী নেছাব, পৃষ্ঠা-১১; ফাজায়েলে তাবলীগ, লেখক- হযরত মাওলানা জাকারিয়া, অনুবাদক- আম্বর আলী, পৃষ্ঠা-৯; তাবলীগে ইসলাম, পৃষ্ঠা-৯, আব্দুস সাত্তার ত্রিশালী; আমি কেন তাবলীগ করি, পৃষ্ঠা-১৫, লেখক- মাওলানা শাহ মনিরুজ্জামান)
————————————————————————————
সূরা আল ইমরান-এর ১১০তম আয়াত শরীফ প্রসঙ্গে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের এই বক্তব্যটি সম্পূর্ণ মনগড়া, বানোয়াট ও বিভ্রান্তিকর এবং কুরআন শরীফের আয়াত শরীফের ভূল ও মনগড়া তাফসীর বা ব্যাখ্যার শমিল, যাকে “তাফসীর বিররায়” বলে। শরীয়তের দৃষ্টিতে “তাফসীর বিররায়” বা মনগড়া তাফসীর বা ব্যাখ্যা করা স্পষ্ট কুফরী। এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “যে ব্যক্তি কুরআন শরীফের মনগড়া তাফসীর করলো, সে কুফরী করলো।”
হাদীস শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে, “যে ব্যক্তি কুরআন শরীফের মনগড়া তাফসীর করে, সে যেন তার স্থান জাহান্নামে নির্ধারণ করে নেয়।”
অন্য রেওয়াতে বর্ণিত আছে, “যে ব্যক্তি বিনা ইল্মে বা না জেনে কুরআন শরীফের ব্যাখ্যা করে, সেও যেন তার স্থান জাহান্নামে নির্ধারণ করে নেয়।” (তিরমিযী, মিশকাত, মিরকাত, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, উরফুশ্শজী, তালীক)
মূলতঃ সূরা আল ইমরান-এর ১১০তম আয়াত শরীফ- “তোমরা মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ উম্মত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করবে এবং আল্লাহ পাকের প্রতি ঈমান আনবে।” দ্বারা কখনোই প্রমাণিত হয়না যে, তাবলীগ তথা দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার কারণে উম্মতে মুহম্মদী শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে। বস্তুত উক্ত আয়াত শরীফের সঠিক তাফসীর বা ব্যাখ্যা না জানার কারণেই এরূপ বিভ্রান্তিমূলক কথা বলা হয়েছে।
উপরোক্ত আয়াত শরীফের সঠিক তাফসীর নিম্নে বর্ণিত হলো-
এ আয়াত শরীফের সঠিক তাফসীরে হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, “আল্লাহ তায়ালা যদি انتم (জমির বা সর্বনাম) বলতেন, তাহলে সমস্ত উম্মতকে বুঝানো হতো। যেহেতু আল্লাহ তায়ালা كنتم (ফে’ল) ব্যবহার করেছেন, সেহেতু খাছ করে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাহাবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণকে বুঝানো হয়েছে।” (হায়াতুস সাহাবা)
অর্থাৎ যদিও এ আয়াত শরীফখানা হযরত সাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের শানে নাযিল হয়েছে, তথাপিও যাঁরা তাঁদের ওয়ারিছ বা নায়েব হবেন, তাঁদের উপরও এ আয়াত শরীফের হুকুম বর্তাবে। যেমন আল্লাহ পাক বলেন, “(ঈমান ও আমলে) সর্বপ্রথম প্রথম স্থান অধিকারী আনছার ও মুহাজির অর্থাৎ হযরত সাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ এবং ইখলাছের সাথে উক্ত সাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের অনুসরণকারী সকলের প্রতিই আল্লাহ পাক সন্তুষ্ট, তাঁরাও আল্লাহ পাকের প্রতি সন্তুষ্ট। হযরত সাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ ও তাঁদের অনুসারীদের জন্য এরূপ বেহেশত নির্ধারিত করে রেখেছেন, যার তলদেশ দিয়ে ঝর্ণা প্রবাহিত হতে থাকবে, তাঁরা চিরদিন সে বেহেশতে অবস্থান করবেন, যা তাঁদের বিরাট সফলতা।” (সূরা তওবা ১০০)
এ আয়াত শরীফ দ্বারা এটাই প্রমাণিত হচ্ছে যে, যাঁরা হযরত সাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের অনুসরণ করবে, তাঁরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত হিসেবে পরিগণিত হবে এবং আল্লাহ পাক-এর সন্তুষ্টি হাছিল করবে।
এখানে উল্লেখ্য যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের ন্যায় আরো অনেকেই সূরা আল ইমরান-এর এই আয়াত শরীফ উল্লেখ করে বলে থাকে যে, আমাদেরকে শ্রেষ্ঠ উম্মত বলা হয়েছে, কারণ সৎ কাজের আদেশ করি ও অসৎ কাজের নিষেধ করি। মূলতঃ তাদের কৃত এ অর্থ ও ব্যাখ্যা কোনটাই সঠিক নয়। কেননা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মত হওয়াটাই হলো আমাদের জন্য শ্রেষ্ঠত্ব। আর এছাড়া আমাদের যতগুলো গুণ দেয়া হয়েছে, তাও একমাত্র হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কারণেই। তাবলীগ তথা দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার কারণেই শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়নি। শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে, একমাত্র সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মত হওয়ার কারণেই।
হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে যে, “সমস্ত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মত হওয়ার জন্য আল্লাহ পাক-এর নিকট আরজু করেছেন।”(তাফসীর সমূহ)
সমস্ত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণের দু’য়াই আল্লাহ পাক কবুল করেছেন, তবে সরাসরি কবুল করেছেন হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম-এর দু’য়া। অনেকে মনে করে থাকে, একমাত্র ঈসা আলাইহিস সালাম ব্যতীত আর কোন নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণের দু’য়াই আল্লাহ পাক কবুল করেননি, এই কথা সঠিক নয়। কেননা হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে, দু’য়া কবুল হয় ৩ প্রকারে-
(১) বান্দা যা চায়, আল্লাহ পাক তা সরাসরি দিয়ে দেন। (২) বান্দা যা চায়, তার চেয়ে যা বেশী জরুরী, তাই আল্লাহ পাক দিয়ে থাকেন, যে জরুরত সম্বন্ধে বান্দা নিজেই জানে না। (৩) বান্দা যা চায়, আল্লাহ পাক তাকে তা দিয়ে তার দু’য়া কবুল করে তার সাওয়াবটুকু পরকালের জন্য জমা করে রাখেন। কিছু বান্দারা যখন হাশরের ময়দানে উপস্থিত হয়ে তাদের নেকী কম দেখবে, তখন তারা অস্থির হয়ে যাবে এই জন্য যে, তাদের জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে যায় কিনা। তখন আল্লাহ পাক বান্দাদেরকে ডেকে বলবেন, “হে বান্দারা! তোমরা অস্থির হয়োনা, তোমাদের জন্য অমুক স্থানে নেকী রাখা হয়েছে।” তখন সেই বান্দারা গিয়ে দেখবে যে, তাদের জন্য পাহাড় পাহাড় নেকী রাখা হয়েছে। তারা বলবে, আল্লাহ পাক! আমরা তো এত নেক আজ করিনি, আমাদের এত পরিমাণ নেকী আসলো কোথা থেকে? তখন আল্লাহ পাক বলবেন, “তোমরা দুনিয়াতে যে সকল দু’য়া করেছিলে, যার বদলা দুনিয়াতে দেয়া হয়নি। তোমরা বুঝতে পারনি, দু’য়া কবুল হলো কি হলোনা, অথচ আমি তা কবুল করেছিলাম এবং সেগুলিই পাহাড় পাহাড় পরিমাণ নেকী আকারে জমা হয়েছে।” তখন বান্দারা বলবে, আল্লাহ পাক! দুনিয়াতে আমাদের সমস্ত দু’য়াগুলিরই বদলা না দিয়ে যদি পরকালের জন্য জমা রাখা হতো, তাহলে তা আমাদের জন্য আরো ফায়দার কারণ হতো। (বুখারী শরীফ, ফত্হুল বারী, ওমাদাতুল বারী, এরশাদুস্ সারী)
উল্লেখ্য যে, শুধুমাত্র দাওয়াতের কারণেই যদি উম্মতে মুহম্মদীর শ্রেষ্ঠত্ব হতো, তাহলে অন্যান্য নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণ দাওয়াতের দায়িত্ব পাওয়া সত্ত্বেও হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মত হওয়ার জন্য আল্লাহ পাক-এর নিকট দু’য়া করতেন না। বরং উম্মতে মুহম্মদীর শ্রেষ্ঠত্ব, দাওয়াতের কারণে নয় বরং হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মত হওয়ার কারণেই।
কুরআন শরীফে আল্লাহ পাক আরো উল্লেখ করেন, “এরূপেই আমি তোমাদেরকে উম্মতে ওয়াসাত (শ্রেষ্ঠ উম্মত) করেছি। যেন তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও সমস্ত মানুষের জন্য এবং যাতে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাক্ষ্যদাতা হন তোমাদের জন্য।” (সূরা বাক্বারা ১৪৩)
এ আয়াত শরীফের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করা হয়, হাশরের ময়দানে যখন সমস্ত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণের গুণাহ্গার উম্মতদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে, “তোমরা কেন নেক কাজ করোনি।” তখন তারা বলবে, দুনিয়াতে আমাদের কাছে কোন আসমানী কিতাবও আসেনি এবং কোন নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামও আগমন করেননি। তখন আল্লাহ পাক নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণকে জিজ্ঞেস করবেন, “আপনারা কি তাদের কাছে দাওয়াত পৌঁছাননি?” তাঁরা বলবেন, “হ্যাঁ, পৌঁছিয়েছি।” তখন অন্য নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণের উম্মতগণ তা অস্বীকার করবে। তখন আল্লাহ পাক বলবেন, “হে নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণ! আপনাদের সাক্ষী কোথায়?” তখন তাঁরা বলবেন, “উম্মতে মুহম্মদীগণই আমাদের সাক্ষী।” তখন উম্মতে মুহম্মদীগণকে ডেকে জিজ্ঞেস করা হলে তাঁরা বলবেন, “হ্যাঁ, সমস্ত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণই তাঁদের দাওয়াত পৌঁছিয়েছেন এবং দায়িত্ব পালন করেছেন।” একথা শুনে অন্যান্য নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণের উম্মতগণ বলবে, উম্মতে মুহম্মদী তো আমাদের থেকে অনেক পরে এসেছেন, তাঁরা কিভাবে আমাদে সাক্ষী হয়? তখন আল্লাহ পাক উম্মতে মুহম্মদীকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তাঁরা বলবেন, “হ্যাঁ, আমরা তাদের থেকে অনেক পরে এসেছি, তবে আমাদের নিকট এসেছিলেন- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তিনি আমাদেরকে এ বিষয়ে জানিয়াছেন। আমরা তাঁর প্রতি ঈমান এনেছি এবং তাঁকে সত্য বলে জেনেছি, তাই আমাদের সাক্ষ্য সত্য।” অতঃপর আল্লাহ পাক হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করবেন এবং তখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, উম্মতে মুহম্মদীকে সমর্থন করে সাক্ষী দিবেন, “হ্যাঁ, তারা যা বলেছে, সবই সত্য এবং আমিই তাদেরকে এ তথ্য জানিয়েছি, যা আমি আল্লাহ পাক-এর তরফ থেকে জেনেছি।” (সিহাহ সিত্তাহ ও সমূহ তাফসীর)
সুতরাং সূরা আল ইমরান-এর উক্ত আয়াত শরীফে আমাদেরকে যে শ্রেষ্ঠ উম্মত বলা হয়েছে, তা দাওয়াতী কাজ করার জন্য নয় বরং তা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রকৃত উম্মত হওয়ার কারণে। (তাফসীরে রুহুল মায়ানী, রুহুল বয়ান, মায্হারী, কুরতুবী, খাযিন, বাগবী, কবীর, ইবনে আব্বাস, আবী সউদ, দুররে মনসুর ইত্যাদি)
এখানে স্মরণীয় যে, কুরআন শরীফের আয়াত শরীফ এবং সহীহ্ হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত আছে যে, পূর্বেকার উম্মতগণের উপরও দাওয়াতের দায়িত্ব ছিল। যেমন আল্লাহ পাক কুরআন শরীফের সূরা ইয়াসীন-এ উল্লেখ করেন, “কোন একজন জনপদে রসূল আলাইহিমুস সালামগণ আগমন করলে সেখানকার অধিবাসীরা তাঁদের (নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণের) রিসালাতকে অস্বীকার করে, হত্যা করার জন্য উদ্যত হলো। তখন শহরের প্রান্তভাগ থেকে এক ব্যক্তি, যিনি ঈমান গ্রহণ করেছিলেন, তিনি দৌড়ে এলেন এবং তার সম্প্রদায়কে রসূল আলাইহিমুস সালামগণকে হত্যা করতে নিষেধ করলেন এবং তাঁদের অনুসরণ করার উপদেশ দিলেন।”
এছাড়া হাদীস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে যে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “আল্লাহ পাক হযরত জীব্রাঈল আলাইহিস সালাম-এর নিকট ওহী পাঠালেন, অমুক শহরের সমগ্র বাসিন্দাসহ উল্টিয়ে দাও।” তখন হযরত জীব্রাঈল আলাইহিস সালাম আরজ করলেন, “হে পরওয়ারদিগার! এ শহরে আপনার অমুক বান্দা রয়েছে, যে মুহূর্তকালও আপনার নাফরমানীতে লিপ্ত হয়নি।” তখন আল্লাহ পাক ইরশাদ করলেন, “শহরটিকে ঐ ব্যক্তি এবং সমগ্র বাসিন্দাসহ উল্টিয়ে দাও। কারণ আমার জন্য ঐ ব্যক্তির চেহারায় এক মুহূর্তের জন্য পরিবর্তন আসেনি, অর্থাৎ সে লোকদের নাফরমানী থেকে নিষেধ করা তো দূরের কথা, আফসোসও করেনি।” (বায়হাক্বী শরীফ)
বণী ইসরাঈল আমলের অনূরূপ আরো একটি ওয়াক্বিয়া (ঘটনা) তাফসীরে উল্লেখ করা হয়- আল্লাহ পাক হযরত ইউশা বিন নুন আলাইহিস সালাম-এর উপর ওহী নাযিল করলেন, “হে আমার নবী আলাইহিস সালাম! আপনার উম্মতের মধ্যে ১ লক্ষ লোককে ধ্বংস করে দেয়া হবে, যার মধ্যে ৬০ হাজার লোক সরাসরি গুনাহে লিপ্ত।” তখন হযরত ইউশা বিন নুন আলাইহিস সালাম বললেন, “হে আল্লাহ পাক! ৬০ হাজার লোক সরাসরি গুনাহে লিপ্ত, তাই তাদের ধ্বংস করে দেয়া হবে। কিন্তু বাকী ৪০ হাজার লোককে ধ্বংস করা হবে কেন?” তখন আল্লাহ পাক বললেন, “যেহেতু তারা তাদের সাথে মিলা-মিশা, ওঠা-বসা করে এবং সম্পর্ক রাখে। আর গুনাহের কাজে বাধা প্রদান করে না, তাই তাদেরকেসহ ধ্বংস করে দেয়া হবে।”
সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, পূর্ববর্তী উম্মতগণের উপরও দাওয়াতের দায়িত্ব ছিল, কেননা দায়িত্ব থাকার কারণেই তা পালন না করায় ‘বণী ইসরাঈল’-এর উল্লিখিত ব্যক্তি ও সম্প্রদায়কে শাস্তি পেতে হয়েছে।
অতএব উপরোক্ত আয়াত শরীফ, হাদীস শরীফ এবং তার আনুষাঙ্গিক ঘটনার মাধ্যমে জানা যায় যে, পূর্ববর্তী উম্মতগণও দাওয়াতের কাজ করেছেন, যা তাফসীরে রুহুল মায়ানী, তাফসীরে মায্হারী, তাফসীরে আমিনিয়া, তাফসীরে খাযিন, তাফসীরে মা’আরিফুল কুরআন ইত্যাদি তাফসীরের কিতাবসমূহ এবং বিশুদ্ধ হাদীস শরীফের কিতাব দ্বারাও প্রমাণিত।
এখানে উল্লেখ্য যে, অন্যান্য নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মত হওয়ার জন্য আরজু করেছেন, তাই বলে কেউ যেন একথা মনে না করে যে, উম্মতে মুহম্মদীর শ্রেষ্ঠত্ব অন্যান্য নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণ হতে বেশী। বরং শুধুমাত্র হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কারণে যে উম্মতে মুহম্মদীর শ্রেষ্ঠত্ব, তা বুঝানোর জন্যই সমস্ত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মত হওয়ার জন্য আরজু করেছেন।
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, উম্মতে মুহম্মদী সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মত হওয়ার কারণেই শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে, তাবলীগ তথা দাওয়াতের কারণে নয়। কাজেই যারা বলে তাবলীগ তথা দাওয়াতের কারণে উম্মতে মুহম্মদী শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে, তাদের কথা সম্পূর্ণই মনগড়া, বানোয়াট ও বিভ্রান্তিকর এবং তাফসীর বিররায় হওয়ার কারণে স্পষ্ট কুফরীর অন্তর্ভূক্ত। আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে এ ধরণের অবান্তর ও কুফরীমূলক কথাবার্তা বলা ও লিখা থেকে হিফাযত করুন। (আমিন!)
প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের ভ্রান্ত আক্বীদা ও তার খন্ডন (৭)
প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের লিখিত কিতাবের বক্তব্য দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, “সূরা হামীম সিজ্দা”-এর ৩৩তম আয়াত শরীফ প্রচলিত তাবলীগের জন্য খাছ। অর্থাৎ একমাত্র প্রচলিত তাবলীগকারীরাই এ আয়াত শরীফের পূর্ণ মেছদাক্ব বা নমুনা।
(ফাজায়েলে তাবলীগ, পৃষ্ঠা-৪; দাওয়াতে তাবলীগ কি ও কে?, লেখক- ওবায়দুল হক, পৃষ্ঠা-১১৮; তাবলীগে ইসলাম, লেখক-আব্দুল সাত্তার ত্রিশালী, পৃষ্ঠা-৯)
————————————————————————————
মূলতঃ উল্লিখিত আয়াত শরীফে আল্লাহ পাক বলেন, “সেই ব্যক্তি অপেক্ষা কার কথা অধিক উত্তম হতে পারে? যিনি আল্লাহ পাক-এর দিকে মানুষকে ডাকেন এবং নেক কাজ করেন এবং বলেন, নিশ্চয়ই আমি মুসলমানের অন্তর্ভূক্ত।” (সূরা হামীম সিজ্দাহ ৩৩)
এই আয়াত শরীফখানা সম্পর্কে হযরত আয়িশা সিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বলেন, “এটা মুযাজ্জিনদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে।” (তাফসীরে মায্হারী)
এখানে উল্লেখ্য যে, কুরআন শরীফের সূরা বা আয়াত শরীফসমূহের নুযুল খাছ অর্থাৎ বিশেষ কারণে নাযিল হয়েছে। কিন্তু হুকুম আম অর্থাৎ ঐ আয়াত শরীফের মেছদাক্ব বা নমুনা যারাই হবে তাদেরই উপর সে হুকুম বর্তাবে।
অতএব, উপরোক্ত আয়াত শরীফ যদিও মুযাজ্জিনের জন্য খাছ করে নাযিল হয়েছে, তথাপিও যাঁরা ঈমান-আক্বীদা শুদ্ধ রেখে আল্লাহ পাক-এর দিকে মানুষকে ডাকবে, তা যেভাবেই হোক, যেমন- কিতাব লিখে, মাদ্রাসায় পড়িয়ে, ওয়াজ করে, তা’লীম দিয়ে, দাওয়াত দিয়ে, জিহাদ করে ইত্যাদি, তাদের সকলের উপরই এ আয়াত শরীফের হুকুম বর্তাবে। (তাফসীরে খাযিন, বাগবী, রুহুল মায়ানী, রুহুল বয়ান, বায়ানুল কুরআন, মায্হারী, ইবনে কাছীর, কবীর, কানযুল ঈমান, তাবলীগী নেছাব-মাওঃ জাকারিয়া)
কাজেই এ আয়াত শরীফকে কখনোই প্রচলিত তাবলীগের জন্য খাছ করে নেয়া শরীয়তসম্মত হবেনা। বরং “তাফসীর বিররায়” হবে, যা কুফরীর অন্তর্ভূক্ত। এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “যে ব্যক্তি কুরআন শরীফের মনগড়া তাফসীর করলো, সে কুফরী করলো।”
হাদীস শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে, “যে ব্যক্তি কুরআন শরীফের মনগড়া তাফসীর করে, সে যেন তার স্থান জাহান্নামে নির্ধারণ করে নেয়।”
অন্য রেওয়াতে বর্ণিত আছে, “যে ব্যক্তি বিনা ইল্মে বা না জেনে কুরআন শরীফের ব্যাখ্যা করে, সেও যেন তার স্থান জাহান্নামে নির্ধারণ করে নেয়।” (তিরমিযী, মিশকাত, মিরকাত, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, উরফুশ্শজী, তালীক)
সুতরাং এরূপ মনগড়া তাফসীর বা ব্যাখ্যা করা সম্পূর্ণ হারাম। কারণ মনগড়া তাফসীর বা ব্যাখ্যার কারণে যেমন নিজে গোমরাহ্ হয়, তেমন অপরকেও গোমরাহ্ করে। যার ফলে সমাজে ফিৎনা বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়, আর হওয়াটাই স্বাভাবিক। অথচ ফিৎনা সৃষ্টি করা কবীরা গুণাহ্র অন্তর্ভূক্ত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, “তোমরা জমিনে ফিৎনা সৃষ্টি করোনা।” (সূরা বাক্বারা ১২)
অন্য আয়াত শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “ফিৎনা হত্যার চেয়ে অধিক শক্ত গুণাহ্।” (সূরা বাক্বারা ১৯১)
অন্য আয়াত শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “ফিৎনা হত্যার চেয়ে অধিক বড় গুণাহ্।” (সূরা বাক্বারা ২১৭)
কাজেই সমাজে ফিৎনা সৃষ্টি হয়, এ ধরণের শরীয়ত বিরোধী কথা বলা প্রত্যেক মুসলমানের বিরত থাকা সমীচীন।
প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের ভ্রান্ত আক্বীদা ও তার খন্ডন (৭)
প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের লিখিত কিতাবের বক্তব্য দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, “সূরা হামীম সিজ্দা”-এর ৩৩তম আয়াত শরীফ প্রচলিত তাবলীগের জন্য খাছ। অর্থাৎ একমাত্র প্রচলিত তাবলীগকারীরাই এ আয়াত শরীফের পূর্ণ মেছদাক্ব বা নমুনা।
(ফাজায়েলে তাবলীগ, পৃষ্ঠা-৪; দাওয়াতে তাবলীগ কি ও কে?, লেখক- ওবায়দুল হক, পৃষ্ঠা-১১৮; তাবলীগে ইসলাম, লেখক-আব্দুল সাত্তার ত্রিশালী, পৃষ্ঠা-৯)
————————————————————————————
মূলতঃ উল্লিখিত আয়াত শরীফে আল্লাহ পাক বলেন, “সেই ব্যক্তি অপেক্ষা কার কথা অধিক উত্তম হতে পারে? যিনি আল্লাহ পাক-এর দিকে মানুষকে ডাকেন এবং নেক কাজ করেন এবং বলেন, নিশ্চয়ই আমি মুসলমানের অন্তর্ভূক্ত।” (সূরা হামীম সিজ্দাহ ৩৩)
এই আয়াত শরীফখানা সম্পর্কে হযরত আয়িশা সিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বলেন, “এটা মুযাজ্জিনদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে।” (তাফসীরে মায্হারী)
এখানে উল্লেখ্য যে, কুরআন শরীফের সূরা বা আয়াত শরীফসমূহের নুযুল খাছ অর্থাৎ বিশেষ কারণে নাযিল হয়েছে। কিন্তু হুকুম আম অর্থাৎ ঐ আয়াত শরীফের মেছদাক্ব বা নমুনা যারাই হবে তাদেরই উপর সে হুকুম বর্তাবে।
অতএব, উপরোক্ত আয়াত শরীফ যদিও মুযাজ্জিনের জন্য খাছ করে নাযিল হয়েছে, তথাপিও যাঁরা ঈমান-আক্বীদা শুদ্ধ রেখে আল্লাহ পাক-এর দিকে মানুষকে ডাকবে, তা যেভাবেই হোক, যেমন- কিতাব লিখে, মাদ্রাসায় পড়িয়ে, ওয়াজ করে, তা’লীম দিয়ে, দাওয়াত দিয়ে, জিহাদ করে ইত্যাদি, তাদের সকলের উপরই এ আয়াত শরীফের হুকুম বর্তাবে। (তাফসীরে খাযিন, বাগবী, রুহুল মায়ানী, রুহুল বয়ান, বায়ানুল কুরআন, মায্হারী, ইবনে কাছীর, কবীর, কানযুল ঈমান, তাবলীগী নেছাব-মাওঃ জাকারিয়া)
কাজেই এ আয়াত শরীফকে কখনোই প্রচলিত তাবলীগের জন্য খাছ করে নেয়া শরীয়তসম্মত হবেনা। বরং “তাফসীর বিররায়” হবে, যা কুফরীর অন্তর্ভূক্ত। এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “যে ব্যক্তি কুরআন শরীফের মনগড়া তাফসীর করলো, সে কুফরী করলো।”
হাদীস শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে, “যে ব্যক্তি কুরআন শরীফের মনগড়া তাফসীর করে, সে যেন তার স্থান জাহান্নামে নির্ধারণ করে নেয়।”
অন্য রেওয়াতে বর্ণিত আছে, “যে ব্যক্তি বিনা ইল্মে বা না জেনে কুরআন শরীফের ব্যাখ্যা করে, সেও যেন তার স্থান জাহান্নামে নির্ধারণ করে নেয়।” (তিরমিযী, মিশকাত, মিরকাত, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, উরফুশ্শজী, তালীক)
সুতরাং এরূপ মনগড়া তাফসীর বা ব্যাখ্যা করা সম্পূর্ণ হারাম। কারণ মনগড়া তাফসীর বা ব্যাখ্যার কারণে যেমন নিজে গোমরাহ্ হয়, তেমন অপরকেও গোমরাহ্ করে। যার ফলে সমাজে ফিৎনা বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়, আর হওয়াটাই স্বাভাবিক। অথচ ফিৎনা সৃষ্টি করা কবীরা গুণাহ্র অন্তর্ভূক্ত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, “তোমরা জমিনে ফিৎনা সৃষ্টি করোনা।” (সূরা বাক্বারা ১২)
অন্য আয়াত শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “ফিৎনা হত্যার চেয়ে অধিক শক্ত গুণাহ্।” (সূরা বাক্বারা ১৯১)
অন্য আয়াত শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “ফিৎনা হত্যার চেয়ে অধিক বড় গুণাহ্।” (সূরা বাক্বারা ২১৭)
কাজেই সমাজে ফিৎনা সৃষ্টি হয়, এ ধরণের শরীয়ত বিরোধী কথা বলা প্রত্যেক মুসলমানের বিরত থাকা সমীচীন।
প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের ভ্রান্ত আক্বীদা ও তার খন্ডন (৮)
প্রচলিত ৬ উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতের সমর্থনপুষ্ট প্রায় কিতাবেই একথা লেখা আছে যে, আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস্ সালামগণ কোন কোন ক্ষেত্রে ভুল করেছেন। যেমন- হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম গন্দম ফল খেয়ে ভুল করেছিলেন, ইত্যাদি। (মালফুযাতে শাইখুল হাদীছ, পৃষ্ঠা ২৩১; তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরু দায়িত্ব, লেখক- মাওলানা ইসমাঈল হোসেন দেওবন্দী, পৃষ্ঠা ৬১) (নাঊযুবিল্লাহ্ মিন যালিক)
————————————————————————————
এরূপ আক্বীদা পোষণ করা গুমরাহী ও কুফরীর অন্তর্ভূক্ত। কারণ সকল নবী-রসূল বা আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণই ছিলেন আল্লাহ্ পাক-এর খাছ ও মনোনীত বান্দাগণের অন্তর্ভূক্ত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ পাক বলেন, “আল্লাহ্ পাক যাকে ইচ্ছা (আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস্ সালামগণকে) মনোনীত করেন।” (সূরা শুয়ারা ১৩)
আল্লাহ্ পাক আরো বলেন, “আল্লাহ্ পাক ফেরেশ্তা ও মানুষের মধ্যে থেকে রসূল মনোনীত করেন।” (সূরা হজ্জ ৭৫)
অর্থাৎ আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণকে আল্লাহ্ পাকই খাছভাবে মনোনীত করেন। কারো পক্ষে সাধনা বা রিয়াজত মুশাক্কাত করে কস্মিনকালেও নবী-রসূল (আলাইহিমুস্ সালাম) হওয়া সম্ভব নয়। আর তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন ওহীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কুরআন শরীফ-এর একাধিক স্থানে ইরশাদ হয়েছে, “আমি তাঁদের (আম্বিয়া আলাইহিমুস্ সালামগণের) প্রতি ওহী পাঠাতাম।” (সূরা ইউসূফ ১০৯, সূরা নহল ৪৩, সূরা আম্বিয়া ৭)
অর্থাৎ আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস্ সালামগণের যাবতীয় কার্যাবলীই ওহীর দ্বারা পরিচালিত হতো। যার প্রেক্ষিতে আক্বাইদের কিতাবে বর্ণিত হয়েছে, “সকল আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণ মা’ছূম বা নিষ্পাপ।”
আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, “সকল আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণই ছগীরা, কবীরা, কুফরী এবং অপছন্দনীয় কাজ হতেও পবিত্র।” (ফিক্বহে আকবর)
এ উছূলের ভিত্তিতে আহ্লে সুন্নত ওয়াল জামায়াত-এর আক্বীদা হলো, কোন নবী-রসূল আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালাম কখনো ভুল-ত্রুটি, গুণাহ্, পাপ, খতা, লগজেশ ইত্যাদি কিছুই করেননি। ইচ্ছাকৃত তো নয়ই, অনিচ্ছাকৃতও নয়। (শরহে আক্বাইদে নসফী, ফিক্বহে আকবর, তাকমীলুল ঈমান, আক্বাইদে হাক্কাহ্)
অতএব, যারা নবী-রসূল আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের গুণাহ্ বা ভুল সম্পর্কে বলে থাকে, তারা আক্বাইদ ও ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ বা মূর্খ থাকার কারণে এবং কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এর সঠিক ব্যাখ্যা না বুঝার কারণে আম্বিয়া আলাইহিমুস্ সালামগণের শানে এরূপ বেয়াদবীমূলক ও কুফরী কথাবার্তা বলে থাকে। উল্লেখ্য, আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের সাথে কতটুকু আদব রক্ষা করতে হবে, সে প্রসঙ্গে কিতাবে একটি ঘটনা উল্লেখ করা হয়,
আশেক্বে ইলাহী, ইমামুশ্ শরীয়ত ওয়াত তরীক্বত, ইমাম মারূফ কারখী রহ্মতুল্লাহি আলাইহি-এর প্রধান খলীফা ও সাইয়্যিদুত্ ত্বইফা হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহ্মতুল্লাহি আলাইহি-এর পীর ছাহেব, হযরত ইমাম সাররী সাক্তী রহ্মতুল্লাহি আলাইহি যিনি তাঁর যামানায় আল্লাহ্-এর লক্ষ্যস্থল এবং ইমামুশ্ শরীয়ত ওয়াত তরীক্বত ছিলেন। তিনি একবার আল্লাহ্ পাক-এর নবী, হযরত ইয়াকুব আলাইহিস্ সালামকে স্বপ্নে দেখে প্রশ্ন করেছিলেন, হে আল্লাহ্ পাক-এর নবী, হযরত ইয়াকুব আলাইহিস্ সালাম! আপনার অন্তরে আল্লাহ্ পাক-এর মুহব্বত সত্যিকারভাবেই প্রবল, তারপরেও আপনি কেন আপনার ছেলে হযরত ইউসুফ আলাইহিস্ সালাম-এর জুদাইয়ের (বিচ্ছেদের) কারণে তাঁর মুহব্বতে ৪০ বছর যাবত কেঁদে কেঁদে আপনার চক্ষু মুবারক নষ্ট করেছিলেন? এ কথা বলার সাথে সাথে গায়েব থেকে নেদা (আওয়াজ) হলো, “হে হযরত সার্রী সাক্তী! নবী (আলাইহিমুস্ সালাম)দের শানে সাবধানে কথা বল।” এরপর হযরত ইউসুফ আলাইহিস্ সালামকে তাঁর সামনে পেশ করা হলে তিনি দেখে বেহুশ হয়ে পড়েন এবং এভাবে একাধারে ১৩ দিন ১৩ রাত বেহুশ থাকার পর হুঁশ ফিরে পান। তখন গায়েব থেকে নেদা হয়, আল্লাহ্ পাক-এর নবী (আলাইহিমুস্ সালাম)দের শানে এরূপ কথা বললে তাদের অবস্থা এরূপই হয়ে থাকে। (তাযকিরাতুল আউলিয়া)
উপরোক্ত ওয়াকিয়া বা ঘটনার আলোকে প্রতিভাত হয় যে, আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস্ সালামগণের শানে তাঁদের শানের খিলাফ কথা বলা সম্পূর্ণই নিষিদ্ধ। অতএব, আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস্ সালামগণের শানে প্রতিক্ষেত্রেই তাঁদের শান ও মর্যাদা রক্ষা করে কথা বলতে হবে। তাঁদের প্রতি সর্বাবস্থায় সুধারণা বা ছহীহ্ আক্বীদা পোষণ করতে হবে এবং যে সকল আয়াত শরীফ, হাদীছ শরীফ ও ঘটনাসমূহ বাহ্যতঃ নবী-রসূল আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের শানের খিলাফ ও ছহীহ্ আক্বীদা পরিপন্থী তা পরিহার করতঃ শান ও ছহীহ্ আক্বীদাসম্মত অর্থ ও ব্যাখ্যা গ্রহণ করতে হবে। হযরত ইমাম সাররী সাক্তী রহ্মতুল্লাহি আলাইহি-এর ঘটনা আমাদের এ শিক্ষাই দেয়।
এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস্ সালামগণের প্রতি যথাযথ আদব রক্ষা করার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের বরকতময় জীবনীতেও রয়েছে। যেমন এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফ-এ উল্লেখ আছে যে, একদা জনৈক ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু! আপনি বড় না হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বড়? জবাবে বিশিষ্ট ও মর্যাদাবান ছাহাবী হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু অত্যন্ত হিকমতপূর্ণ জবাব দিলেন এই বলে যে, তিনি অবশ্যই আমার চেয়ে অনেক বড় (মর্যাদাবান)। তবে আমি দু’বছর আগে বিলাদত লাভ করেছি। (সুবহানাল্লাহ্)
অতএব, বিশিষ্ট ও মর্যাদাবান ছাহাবী হযরত আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর উপরোক্ত হিকমতপূর্ণ কথা বা বক্তব্য দ্বারা এটাই প্রমাণিত হলো যে, হযরত আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস্ সালামগণ সম্পর্কে খুব আদব ও সতর্কতার সাথে কথা বলতে হবে। কারণ বেয়াদব সম্পর্কে হযরত জালালুদ্দীন রুমী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “বেয়াদব আল্লাহ্ পাক-এর রহ্মত থেকে বঞ্চিত।” (মসনবী শরীফ)
স্মরণীয় যে, আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস্ সালামগণ ভুল করা তো দূরের কথা, কোন প্রকার অপছন্দীয় কাজও তাঁরা করতেন না। বরং সর্ব প্রকার অপছন্দনীয় কাজ থেকেও পবিত্র। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়,
“একবার আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুজরা শরীফ-এ বসা ছিলেন। এমতবস্থায় এক ব্যক্তি এসে আল্লাহ্ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে সাক্ষাৎ করার অনুমতি চাইলেন। এ সংবাদ উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দিক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট পৌঁছালেন। তখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সে ব্যক্তিকে অপেক্ষা করতে বললেন। এ কথা বলে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পাগড়ী মুবারক, কোর্তা মুবারক ইত্যাদি গুছগাছ করে নিলেন। এমনকি হুজরা শরীফ থেকে বের হওয়ার মুহূর্তে পানির গামলাতে নিজের চেহারা মুবারক দেখে গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। তা দেখে সে সময় হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বললেন, ‘ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনিও কি এরূপ করেন?’ তিনি বললেন, ‘কিরূপ?’ হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বললেন, ‘এরূপ পরিপাটি।’ এর জবাবে আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘আমরা আল্লাহ্ পাক-এর নবী ও রসূল। আমাদের কোন কাজ কারো অপছন্দ হলে, সে ঈমানহারা হয়ে যাবে।” (আল মুরশিদুল আমীন)
অতএব, আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস্ সালামগণ যে, কতটুকু অপছন্দীয় কাজ থেকে বেঁচে থাকতেন, এ হাদীছ শরীফ থেকে বর্ণিত ঘটনা তারই প্রমাণ। তাহলে কি করে এ কথা বলা যেতে পারে বা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে যে, আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস্ সালামগণ ভুল-ত্রুটি, গুণাহ্, নাফরমানী ইত্যাদি করেছিলেন? বস্তুতঃ এরূপ আক্বীদা পোষণ করা সম্পূর্ণই হারাম ও কুফরী এবং ঈমানহারা তথা বেঈমান হওয়ার কারণ।
আরো উল্লেখ্য যে, আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ শরীফ বর্ণনাকারীদেরকে “রাবী” বলা হয়। এই রাবীগণের মধ্যে যাঁরা প্রথম শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত, তাঁদেরকে বলা হয় “ছেক্বাহ্ রাবী।” হাদীছ শরীফ বিশারদ রহ্মতুল্লাহি আলাইহিমগণ “ছেক্বাহ রাবী” হওয়ার জন্য যে মানদণ্ড নির্ধারণ করেছেন, তার মধ্যে মূল বিষয় হচ্ছে- (১) আদালত ও (২) জব্ত।
“জব্ত” হলো প্রখর স্মরণশক্তি যা একবার শুনলে আর কখনো ভুলে না। আর “আদালত”-এর মধ্যে চারটি শর্ত। তার মধ্যে প্রধান দু’টি হলো (ক) তাক্বওয়া, (খ) মুরুওওয়াত।
(ক) “তাক্বওয়া” হচ্ছে কুফরী, শেরেকী, বিদ্য়াতী, ফাসিকী কাজ থেকে বেঁচে থাকার সাথে সাথে কবীরা গুনাহ থেকে এমনকি ছগীরা গুনাহও বার বার করা থেকে বেঁচে থাকা।
(খ) “মুরুওওয়াত” হচ্ছে অশালীন, অশোভনীয়, অপছন্দনীয় এমনকি দৃষ্টিকটু কাজ থেকে বিরত থাকা। যেমন- রাস্তায় হেঁটে, হেঁটে খাদ্য খাওয়া, রাস্তায় অট্টহাস্য করা, চিৎকার করা ইত্যাদি।
আরো উল্লেখ্য যে, হাদীছ শরীফ বিশারদ রহ্মতুল্লাহি আলাইহিমগণ তাঁদের বর্ণিত হাদীছকে “মওজূ” বা বানোয়াট বলে সাব্যস্ত করেছেন, যারা জীবনে একবার মাত্র ইচ্ছাকৃতভাবে হাদীছ শরীফ-এর ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলেছেন বলে প্রমাণিত হয়েছে। আর যারা জীবনে ব্যক্তিগতভাবে মিথ্যা বলেছেন বলে প্রমাণিত হয়েছে তাদের বর্ণিত হাদীছ শরীফকে “মতরুক” বা পরিত্যাজ্য বলে সাব্যস্ত করেছেন। (তাদরীবুর রাবী, মুকাদ্দামাতুশ শায়খ, মীযানুল আখবার)
এখন ফিকিরের বিষয় এই যে, হাদীছ শাস্ত্র বিশারদ রহ্মতুল্লাহি আলাইহিমগণ আল্লাহ্ পাক-এর বান্দা ও রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মত হওয়া সত্ত্বেও তাদের মতে আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র হাদীছ শরীফ বর্ণনা করার ক্ষেত্রে রাবীগণকে “বিশ্বস্ত বর্ণনাকারী বা ছেক্বাহ রাবী” হিসেবে মনোনীত বা চিহ্নিত করতে ছেক্বাহ রাবীর যদি এত শর্ত-শারায়েত ও যোগ্যতার প্রয়োজন হয়, অর্থাৎ যদি কেউ জীবনে একবার মিথ্যা বলে তাহলে ছেক্বাহ রাবী হওয়া তো দূরের কথা তার কোন হাদীছই গ্রহণযোগ্য নয় বলে শর্তারোপ করা হয়েছে। এরপর ছগীরা গুণাহ্ তো দূরের কথা যা সাধারণ মুরুওয়াতের খিলাফ, যেমন রাস্তায় হেঁটে হেঁটে যদি কেউ খাদ্য খায় সেও ছেক্বাহ্ রাবীর অন্তর্ভূক্ত হতে পারে না। তবে যিনি হাদীছ বিশারদ রহ্মতুল্লাহি আলাইহিমগণসহ সকলেরই রব ও খালিক, তিনি তাঁর পবিত্র কালাম বর্ণনা করা বা পৌঁছে দেয়া বা ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে যাঁদেরকে নবী ও রসূল (আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস্ সালাম) হিসেবে মনোনীত করেছেন, তাঁদের জন্য কি মানদন্ড নির্ধারণ করেছেন বা কতটুকু শর্তারোপ করেছেন? তাঁদেরকে কতটুকু যোগ্যতা দান করেছেন? আর তাঁরা কতটুকু মাহ্ফুজ ও মা’ছূম হওয়া শর্তারোপ করেছেন? আর ছেক্বাহ্ রাবীর তুলনায় তাঁদের কত বেশী যোগ্যতা, মা’ছূম ও নিষ্পাপ হওয়া প্রয়োজন? বলার অপেক্ষাই রাখে না যে, আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস্ সালামগণ ছেক্বাহ্ রাবীগণের চেয়েও বহু বহু গুণে যোগ্যতা সম্পন্ন মাহ্ফুজ ও মা’ছূম। অতএব, তাঁদের দ্বারা ভুল-ত্রুটি, গুণাহ্ ইত্যাদি প্রকাশ পাওয়ার প্রশ্নই উঠে না।
মূলতঃ তাদের এ কথা সঠিক নয় বরং ভুল ও কুফরীযুক্ত। প্রকৃত ঘটনা হলো- আল্লাহ্ পাক যখন হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম ও হযরত হাওয়া আলাইহাস্ সালামকে আদেশ করেছিলেন যে,“আপনারা এই (গন্দম) গাছের নিকটবর্তী হবেন না।” (সূরা বাক্বারা ৩৫)
তখন তাঁরা আল্লাহ্ পাক-এর আদেশ অনুযায়ী সে গাছের নিকটবর্তী হননি। বরং উক্ত গাছের অনুরূপ বিপরীত দিকের অন্য একটি গাছ দেখিয়ে ইবলিস শয়তান এসে হযরত হাওয়া আলাইহাস্ সালামকে মিথ্যা কছম খেয়ে বলেছিল যে, যদি আপনারা এই গাছের ফল খান, তবে আপনারা ফেরেশ্তা হয়ে যাবেন অথবা স্থায়ীভাবে বেহেশ্তে বসবাস করতে পারবেন। কোন কোন বর্ণনা মুতাবিক তখন হযরত হাওয়া আলাইহাস্ সালাম সে গাছ হতে ফল এনে শরবত বানিয়ে হযরত আদম আলাইহিস্ সালামকে খাইয়েছিলেন। অপর বর্ণনায় ফল কেটে খাইয়েছিলেন। এ ঘটনা হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম-এর অজান্তে সংঘটিত হয়েছিল। সুতরাং যা অজান্তে সংঘটিত হয়, তা কি করে ভুল বা অপরাধ হতে পারে? বাস্তবিক তা কখনোই ভুল হতে পারে না।(সমূহ তাফসীরের কিতাব)
এর মেছাল বা উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, হযরত ইমাম হাসান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর শাহাদাত-এর ঘটনা। তিনি শাহাদাত বরণ করেছিলেন, এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। উনাকে ইসলামের শত্রুরা শহীদ করার জন্য একে একে পাঁচবার বিষ পান করায়। কিন্তু আল্লাহ্ পাক-এর রহ্মতে তিনি প্রত্যেক বারই বেঁচে যান। ষষ্ঠবার তাঁকে শহীদ করার জন্য তাঁর পানির কলসিতে, যে কলসির মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখতেন, যেন তার ভিতরে কিছু ফেলা না যায়, সেই কাপড়ের উপর শত্রুরা হিরক চূর্ণ বিষ তাঁর অজান্তে মিশিয়ে দিয়েছিল। তিনি গভীর রাতে হিরক চূর্ণ বিষ মিশ্রিত পানি কলস থেকে ঢেলে পান করেন, যার ফলশ্রুতিতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। যা তাঁর অজান্তেই সংঘটিত হয়েছিল। (সিররুশ্ শাহাদাতাঈন, শুহাদায়ে কারবালা, সীরাতে ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা)
এখন প্রশ্ন উঠে, শরীয়তের দৃষ্টিতে তাঁর শাহাদাতকে আত্মহত্যা বলতে হবে, না ভুল করার কারণে ইন্তিকাল করেছেন তা বলতে হবে? মূলতঃ উপরোক্ত দু’টির কোনটাই বলা যাবে না। যদি কেউ কোন একটি বলে, তবে সে মিথ্যা তোহমত দেয়ার গুনাহে গুনাহগার হবে, যা কুফরীর শামিল হবে। তদ্রুপ হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম-এর ঘটনাও। যা তাঁর অজান্তে সংঘটিত হয়েছিল। অনুরূপ অন্যান্য নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণের ঘটনাও। কাজেই এক্ষেত্রে হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম-এর গুণাহ্ হওয়া তো দূরের কথা প্রকৃতপক্ষে তাঁর কোন ভুলও হয়নি।
এখন কেউ বলতে পারে, যদি হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম-এর কোন ভুলও না হয়ে থাকে তবে, وَعَصٰٓي اٰدَمُ رَبَّهُ এ আয়াত শরীফ-এর সঠিক অর্থ কি?
মূলতঃ এ আয়াত শরীফ-এর সঠিক অর্থ হলো, “(মহান আল্লাহ্ পাক-এর হিকমত হেতু) হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম-এর দ্বারা (তাঁর অজান্তেই) তাঁর রবের হুকুমের খিলাফ কাজ সংঘটিত হয়ে গেল।”
অনুসণীয় মুহাক্কিক ও মুদাক্কিক্বগণ উক্ত আয়াত শরীফ-এর এরূপ অর্থই করে থাকেন। আর এরূপ অর্থই নবী-রসূল আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস্ সালামগণের শান ও আহ্লে সুন্নত ওয়াল জামায়াত-এর আক্বীদাসম্মত। অর্থাৎ হযরত ইমাম হাসান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর অজান্তেই তাঁর দ্বারা বিষ পানের ঘটনা সংঘটিত হওয়ার কারণে যেরূপ একথা বলা জায়িয নেই যে, তিনি ভুল ও আত্মহত্যা করেছেন। ঠিক তদ্রুপ হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম-এর দ্বারা তাঁর অজান্তে গন্দম খাওয়ার কাজ সংঘটিত হওয়ার কারণে এ কথা বলা জায়িয হবে না যে, হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম ভুল-ত্রুটি, খতা, লগজেশ, নাফরমানী, গুণাহ্, পাপ, আদেশ অমান্য ইত্যাদি করেছেন।
মানুষ সঠিক ইতিহাস না জানার কারণে এবং কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এর সঠিক ব্যাখ্যা না জানার ও না বুঝার কারণে নবী-রসূল আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস্ সালামগণের শানে বেয়াদবীমূলক কুফরী কথাবার্তা বলে থাকে। আর উনাদের শানের বিন্দুমাত্র খিলাফ কথাবার্তা বলা সম্পূর্ণ নাজায়িয, হারাম ও কুফরী। এ ধরনের কুফরী আক্বীদা থেকে বেঁচে থাকা সমস্ত মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরয।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন